রফিক, আনোয়ারদের কাঁধে চেপেই মা কুমোরটুলি থেকে সপরিবারে মণ্ডপমুখী, এবার দুর্গাপুজোয় রোজগার ভালো হওয়ায় খুশি কুলিরা
বর্তমান | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সুকান্ত বসু, কলকাতা: রফিক হোসেন, শেখ আনোয়ারদের কাঁধে চেপেই সপরিবারে বাপের বাড়ি চলেছেন উমা। কুমোরটুলির পটুয়াপাড়ায় মৃৎশিল্পীদের ঘর খালি করে একের পর এক প্রতিমা চলেছে মণ্ডপে। এই প্রতিমাকে কাঁধে করে ম্যাটাডর বা লরিতে তুলে দেওয়ার কাজ যাঁরা করে চলেছেন, তাদের দলেই রয়েছেন রফিক, আনোয়াররা। রফিকের বাড়ি মালদহের কালিয়াচকে আর শেখ আনোয়ার এসেছেন মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ থেকে। তাঁদের কথায়, রুটিরুজির টানে প্রতি বছরই এই সময় কুমোরটুলিতে আসি কুলির কাজ করতে। ভাসান মিটলে বাড়ি চলে যাব। রফিক একধাপ এগিয়ে বললেন, ‘কী করব, বাবা-মায়ের ওষুধের খরচ জোগানোর পর ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। সারা বছর হাতের কাছে যখন যা কাজ পাই, তাই করি।’
ঝড়-জল উপেক্ষা করেই গত দু’সপ্তাহ ধরে কুমোরটুলি ও আশপাশ চত্বরে তাঁবু গেড়েছেন রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা প্রতিমা বাহকরা। দুপুরে কুমোরটুলি স্ট্রিটের এক মৃৎশিল্পী ঘর থেকে একটি একচালার দুর্গা গাড়িতে তুলছিলেন কয়েকজন কুলি। তাঁদেরই একজন সুজয় পোড়েল, বাড়ি ক্যানিংয়ে। হঠাৎ তাঁর মোবাইল ফোন বেজে ওঠায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে ধরে বললেন, ‘এখন ফোন রাখো। হাতে অনেক কাজ। নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই।’ কে ফোন করেছিল? প্রশ্ন করতেই বললেন, স্ত্রী। বলুন তো,কাঁধে দুর্গা নিয়ে ফোনে কথা বলা যায়! সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আটটি ছোট-বড় প্রতিমা লরি, ম্যাটাডোরে তুলেছি। এখনও ভাত খাওয়ার ফুরসত পাইনি। লক্ষ্মীকান্তপুরের বাসিন্দা বাপ্পা গায়েন, শ্যামল সাপুই বলেন, ‘বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পাঁচটি প্রতিমা পৌঁছে দিয়েছি কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপে। ওই পাঁচ জায়গা থেকে বিসর্জনের দিনও আমাদের ডাক পড়েছে। পুজোর মরশুমেই আমরা দু’টো পয়সা রোজগার করি। তা দিয়েই সংসারটা কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া যায়। তবে এবার বাজার ভালো। পুজোর উদ্যোক্তারা ভালো টাকা বকশিস দিচ্ছেন। এই কুলিদের সঙ্গেই এসেছেন গৌতম সামন্ত, পরিতোষ বৈদ্যরা। তাঁরা বলেন, ‘এ নিয়ে তিন বছর আসছি কুমোরটুলিতে। প্রথমে কয়েকদিন কাজ পায়নি। কিন্তু বৃষ্টি থামতেই আমাদের কাজ বেড়ে গিয়েছে। এক একটি বড় দুর্গাপ্রতিমা কুমোরটুলির ঘিঞ্জি এলাকা থেকে বের করে লরি বা ট্রাকে তুলতে ১০-১৫ জন কুলি লাগে।
এদিন ভোর থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত আমরা ১৪ জন মিলে তিনটি বড় ঠাকুর ট্রাকে তুলেছি। পঞ্চমী পর্যন্ত এই বাজার পাব।’ কবে বাড়ি ফিরবেন? উত্তরে তাঁরা বলেন, ‘লক্ষ্মীপুজো মিটলে বাড়ি ফিরব। অনেক বনেদি বাড়িতে লক্ষ্মী প্রতিমা নিয়ে যাওয়া ও নিরঞ্জনের কাজ আমাদেরই করতে হয়। তারপর বাড়ি গেলেও কয়েকদিনের মধ্যে ফের চলে আসি কুমোরটুলিতে। কালী এবং জগদ্ধাত্রী বইতে হবে তো!’ বাসন্তীর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছেন পাঁচ বাহক সঞ্জয় মণ্ডল, সুশান্ত মণ্ডল, শৈলেন সামন্ত, কাজল পান ও সমর দাস। এদিন রবীন্দ্র সরণিতে একটি পাইস হোটেলে তাঁদের সঙ্গে দেখা। কথা প্রসঙ্গে তাঁরা জানালেন, ‘প্রতি বছরই আমরা আসি এবং এই হোটেলেই ভাত খাই। রাতের খাবার মুড়ি বা ছাতু। ফুটপাতেই রাত কাটে আমাদের। তবে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে খানিক অসুবিধা হয়েছে ঠিকই। ভোর থেকেই শুরু হয়ে যায় মণ্ডপে প্রতিমা পৌঁছে দেওয়ার কাজ। আমরা গরিব, সেই অর্থে পড়াশোনা জানি না। বছরের অন্য সময় নদীতে মীন ধরার কাজ করি। পুজোর মরশুমে চলে আসি এই শহরে কুলির কাজ করতে।’
আর পাঁচজন কুলির সঙ্গে দুর্গা প্রতিমা টানতে টানতে হাঁফিয়ে উঠছিলেন প্রৌঢ় শম্ভু নস্কর। তিনি তাঁর সঙ্গী দুই কুলিকে বললেন, ‘একটু জিরিয়েনি। তারপর না হয় আবার টানব।’ নানা দুঃখ-যন্ত্রণার মাঝে এবার রোজগার একটু ভালো হওয়ায় খুশি কুলিরা। তাঁদের বক্তব্য, দুঃখ আমাদের সব সময়ের সাথী। তাই আমাদের ঘরে পুজোর আনন্দ মলিন।