সর্ষের মধ্যেই কি রয়েছে ভূত? ফের বড়সড় কেলেঙ্কারির গন্ধ কলকাতা পুরসভার একটি প্রকল্প ঘিরে।
উত্তর কলকাতার পামারবাজারে ৫৪ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকায় একটি নিকাশি পাম্পিং স্টেশন তৈরি করবে কলকাতা পুরসভা। এর জন্য গত সেপ্টেম্বরে ই-টেন্ডার ডেকেছিল তারা। তাতে অংশগ্রহণকারী একটি সংস্থাকে কাজের বরাতও দেওয়া হয়েছিল গত এপ্রিলে। কিন্তু পুরসভার কেন্দ্রীয় অডিট দফতর সম্প্রতি জানিয়েছে, বরাত পাওয়া সংস্থাটির দেওয়া যাবতীয় নথি ভুয়ো। ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাঙ্ক মিলিয়ে ৯৬১ কোটি ৯৭ লক্ষ টাকা বকেয়া ঋণ রয়েছে তাদের।
বরাতপ্রাপ্ত ওই সংস্থা নিজেদের ‘স্বচ্ছতা’র প্রমাণ দিতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চিফ ম্যানেজারের সই ও স্ট্যাম্প জাল করে ভুয়ো শংসাপত্র বানিয়ে পুরসভায় জমা দিয়েছে। সেই শংসাপত্রের উপরে তারিখ লেখা আছে ১০ জানুয়ারি, ২০২৫। চলতি মাসের ৬ তারিখ নিকাশি স্টেশন নির্মাণ সংক্রান্ত সমস্ত ফাইল পুরসভার কেন্দ্রীয় অডিট দফতরের হাতে আসে। আধিকারিকেরা ওই ফাইল খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বিস্তর গরমিল খুঁজে পান। কেন্দ্রীয় অডিট দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে পুরসভা সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চায়, তাঁরা ওই সংস্থাকে এমন কোনও শংসাপত্র দিয়েছেন কিনা। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ গত ১০ সেপ্টেম্বর পুরসভাকে জানিয়েছেন, এমন কোনও শংসাপত্র তাঁদের তরফে দেওয়া হয়নি!
এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় প্রকল্পের বরাত দেওয়ার আগে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া ওই সংস্থার যাবতীয় নথি যাচাই করে দেখা হল না কেন? বিজেপির পুরপ্রতিনিধি সজল ঘোষের অভিযোগ, ‘‘কলকাতায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে নিত্যনতুন নিকাশি পাম্পিং স্টেশন গড়ছে পুরসভা। যদিও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই শহর ডুবে যায়। গত সোমবার রাতের বৃষ্টির পরে তিন-চার দিন জলমগ্ন রইল শহরের বহু এলাকা। পামারবাজারে প্রস্তাবিত পাম্পিং স্টেশনের বরাত দেওয়ার পরে অডিট দফতরের পর্যালোচনায় জানা গিয়েছে, ওই সংস্থাটি ভুয়ো নথি দিয়ে কাজ পেয়েছিল। এর থেকেই পরিষ্কার, কোটি কোটি টাকা স্রেফ জলে যাচ্ছে! বরাত দেওয়ার আগে পুরসভা সমস্ত নথি পরীক্ষা করে নেয়নি কেন? গোটা ঘটনার তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। ওই সংস্থাকে সুবিধা পাইয়ে দিতে যে বা যাঁরা সচেষ্ট ছিলেন, তাঁদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।’’
পুরসভার কেন্দ্রীয় অডিট দফতর সূত্রের খবর, ওই সংস্থাটি ২০২২ সালে অসমে প্রায় ৫৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের রাস্তা তৈরির বরাত পেয়েছিল। সেখানেও কাজে ব্যর্থ হওয়ায় ‘ন্যাশনাল হাইওয়েজ় অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড’ (এনএইচআইডিসিএল) ওই সংস্থাকে ‘নন-পারফর্মার’ বলে ঘোষণা করে। তিন বছর আগে রাস্তা নির্মাণকারী জাতীয় সংস্থা ওই বেসরকারি সংস্থাটিকে ‘নন-পারফর্মার’ বলে ঘোষণা করলেও কেন সেই সংস্থাকেই পুরসভা বরাত দিল, এই প্রশ্ন-সহ আরও সাত দফা বিষয় পুরসভার কাছে জানতেচেয়েছে কেন্দ্রীয় অডিট দফতর। কিন্তু এখনও সে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়নি পুরসভা।
বাম পুরপ্রতিনিধি মধুছন্দা দেবের প্রশ্ন, ‘‘বরাতপ্রাপ্ত ওই সংস্থার বিরুদ্ধে আগে থেকেই দুর্নীতির বড় অভিযোগ ছিল। অথচ, পুরসভা টেন্ডার ডেকে সেই ভুয়ো সংস্থাকেই কাজের বরাত দিল। এতে বড়সড় দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছি। পুরো ঘটনার তদন্তের দাবি করছি।’’
পুরসভার মেয়র পারিষদ (নিকাশি) তারক সিংহের অবশ্য দাবি, ‘‘কেন্দ্রীয় অডিট দফতর ধরার আগেই আমরা বিষয়টি জানতে পেরে ব্যবস্থা নিয়েছি। ওই সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করেছি। আমার কাছে সইহীন একটি চিঠি আসে। তাতে লেখা ছিল, নিকাশি পাম্পিং স্টেশন নির্মাণের বরাতপ্রাপ্ত সংস্থাটি ব্যাঙ্কের কর্তার সই জাল করে পুরসভাকে ভুয়ো নথি দিয়েছে। আমি নিকাশি দফতরের ডিজি-কে তদন্ত করতে বলি। জানতে পারি, ওই সংস্থাটি পুরসভাকে ভুয়ো নথি জমা দিয়েছে।’’ তারক বলেন, ‘‘এর পরে আমি বিষয়টি নিয়ে মেয়র, পুর কমিশনার, পুরসভার মুখ্য আইন আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলি। পুরো বিষয়টি আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।’’
কিন্তু, এত বড় প্রকল্পের বরাত দেওয়ার আগে ওই সংস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া বা নথি যাচাই করা হল না কেন?’’ উত্তরে মেয়র পারিষদ (নিকাশি) বলেন, ‘‘সইহীন চিঠিটি না এলে আমরা সত্যিই কিছু জানতে পারতাম না। ব্যাঙ্ককর্তার সই, স্ট্যাম্প জাল করলে আমরা ধরব কী ভাবে?’’