লাদাখে ঠিক কীভাবে শুরু হয় গোলমাল? প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ...
আজকাল | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: লাদাখের রাজধানী লে শহরের শহীদ উদ্যান গত ২৪ সেপ্টেম্বর রূপ নিল এক বিভীষিকাময় ঘটনার সাক্ষীতে। শিক্ষাবিদ ও ম্যাগসেসে পুরস্কারজয়ী সোনম ওয়াংচুকের নেতৃত্বে চলা শান্তিপূর্ণ অনশন কর্মসূচির ১৫তম দিনে যখন হাজার হাজার মানুষ বিশেষ সাংবিধানিক সুরক্ষা ও ষষ্ঠ তফসিলের দাবিতে সমবেত হয়েছিলেন, ঠিক তখনই পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে রণক্ষেত্রের দৃশ্য তৈরি হয়। চারজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন এবং অন্তত ৯০ জন, যাদের বেশিরভাগই কিশোর, গুরুতরভাবে আহত হন।
লে-র সোনম নরবু মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৯ বছরের এক তরুণ সামফেল (ছদ্মনাম) জানালেন, কীভাবে তার পায়ে ঢুকে বেরিয়ে যায় পুলিশের ছোড়া গুলি। সরকারি চাকরির প্রত্যাশী এই কলেজছাত্র বললেন—“সকাল থেকে সব শান্তিপূর্ণই চলছিল। কিন্তু দুপুর ৩টার দিকে হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পাই। বাইরে বেরিয়েই দেখি পুলিশ ও সিআরপিএফ সোজাসুজি আমাদের দিকে গুলি চালাচ্ছে। বয়স্ক, নারী—কেউই রেহাই পায়নি।”
চোখের দেখা বর্ণনা করা একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানালেন, সকাল ১১টা নাগাদ কিছু তরুণ শহীদ উদ্যানে থাকা প্রবীণ আন্দোলনকারীদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে শোভাযাত্রা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন লাদাখ স্বায়ত্তশাসিত পাহাড়ি উন্নয়ন পরিষদের (LAHDC) কার্যালয় ও প্রশাসনিক দপ্তরের দিকে। সেখানেই বিশাল পুলিশ মোতায়েনের সামনে সংঘর্ষ বাঁধে। এক পর্যায়ে বিজেপির লাদাখ কার্যালয় ঘিরে ফেলে বিক্ষোভকারীরা এবং সেখানেই এক তরুণ বিক্ষোভকারী মাথায় গুলিবিদ্ধ হন।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিজেপি কার্যালয়ের উপর থেকে সরানো হয় দলের পতাকা, কিন্তু জাতীয় পতাকা অক্ষত থাকে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিজেপি অফিস, পুলিশ ভ্যান ও প্রশাসনিক ভবন আগুনে পুড়ে যায়। লাদাখ পুলিশের মহাপরিচালক এস. ডি. এম. জামওয়াল দাবি করেছেন, আন্দোলনকারীদের হিংস্রতা প্রতিহত করতেই গুলি চালানো হয়। তার মতে, “যদি সময়মতো ব্যবস্থা না নিতাম, পুরো শহর পুড়ে যেত।” অন্যদিকে আহত প্রাক্তন সেনা সদস্য স্তানজিন ওতসাল অভিযোগ করলেন: “ওরা বিন্দুমাত্র সংযম দেখায়নি। জলকামান বা রাবার বুলেট ব্যবহার করা যেত, কিন্তু তারা পেলেট আর আসল গুলিই চালাল।”
ওতসাল, যিনি সেনা জীবনের পর থেকে আন্দোলনে সক্রিয়, বললেন: “আমরা শুধু লাদাখের ভবিষ্যৎ রক্ষার দাবি তুলেছি। জমিই আমাদের একমাত্র সম্পদ। জমি যদি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, আমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।” ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আলাদা করে লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার পর থেকেই মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিজেপি ষষ্ঠ তফসিলের মর্যাদা ও রাজ্যত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তা পূরণ হয়নি।
স্থানীয় যুবক নরবু হাসপাতালের শয্যা থেকে বলেন: “সোনম ওয়াংচুক আমাদের সচেতন করেছেন, জমি ও সংস্কৃতি আমাদের টিকে থাকার মূলভিত্তি। কিন্তু সরকার তাকে দমন করার চেষ্টা করছে। উন্নয়নের নামে জমি লুট হচ্ছে, চাকরির সুযোগ নেই।” লাদাখে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চগুলির মধ্যে একটি। সম্প্রতি প্রায় ৪৭ হাজার তরুণ মাত্র ৫০০ সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করেন। এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় বাজেটে বহু-বিলিয়ন ডলারের সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়, যা স্থানীয়দের জমি অধিগ্রহণের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
কঠোর দমন-পীড়ন ও সোনম ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইন (NSA) প্রয়োগ সত্ত্বেও লাদাখিদের দৃঢ়তা ভাঙেনি। ওতসালের কথায়“আমি দেশের জন্য সেনা জীবনে লড়েছি। এখন লাদাখের অধিকারের জন্য জীবন দিতে হলেও দেব।” এই রক্তক্ষয়ী দমনপীড়ন কেবল লাদাখে নয়, গোটা দেশের গণতন্ত্রের প্রশ্নে নতুন বিতর্ক ছড়িয়েছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালানোর ঘটনাকে স্থানীয়রা শুধু বেআইনি নয়, লাদাখের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের পরিকল্পনা বলেই দেখছেন।