এক মণ্ডপে তিন প্রতিমার পুজো! মুর্শিদাবাদের 'মা বুড়ি'র পুজো শুরু, বোধনেই জমজমাট ভিড় রায়চৌধুরী বাড়িতে ...
আজকাল | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: আজ দুর্গাপুজোর বোধন। বছর পেরিয়ে উমা এসেছেন শ্বশুরবাড়িতে নিজের ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে। বারোয়ারি পুজোগুলোর সঙ্গে উৎসবের আনন্দে মেতেছে জেলার ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক পুজোগুলো।
প্রতিবছরই মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম থানার পাশলা গ্রামের রায় এবং রায়চৌধুরী পরিবারের প্রাচীন দুর্গাপুজো নজর কাড়ে জেলাবাসীর। এখানে একই মণ্ডপে তিনটি দুর্গা প্রতিমার পুজো করা হয়। যা 'মা বুড়ি' নামে খ্যাত। আর এই দুর্গাপুজো দেখতে বোধনের দিন থেকেই এখানে উপচে পড়ে দর্শনার্থীর ভিড়।
পরিবারের সদস্য কুনাল রায় চৌধুরী বলেন, 'রবিবার সকালে স্থানীয় পলাশ পুকুরে পুজোর ঘটে ভরার মধ্যে দিয়ে আমাদের পুজোর সূচনা হয়েছে। আজ থেকেই আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর শুরু হয়ে গেল। আজ ষষ্ঠী পুজোর সময় দেবীর উদ্দেশ্যে ছাগ বলিদান হবে। তিনটি প্রতিমাকে ইতিমধ্যে নিজেদের বেদীতে বসানো হয়েছে।'
রায় পরিবারের ইতিহাস অনুযায়ী শশীকান্ত রায় এই পুজোর প্রচলন করলেও পরবর্তীকালে ওই গ্রামেরই কৃষ্ণচন্দ্র এবং গিরি রায়চৌধুরী (অনেকে মনে করেন এই দু'জন শশীকান্তের কাকার ছেলে) নামে দুই ব্যক্তি শশীকান্তের পুজোর পাশাপাশি নিজেদের মতো করে দু'টি আলাদা দুর্গাপুজো শুরু করেন। এরও পরবর্তীকালে একই পুজো মণ্ডপে তিনটি আলাদা আলাদা মূর্তি তৈরি করে পুজো করা হয়। বর্তমানে 'মা বুড়ি' নামে খ্যাত মূল পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন রায়চৌধুরী পরিবার। পাশাপাশি শশীকান্তের শুরু করা পুজোর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তাঁর বংশধর প্রশান্ত রায়। আর মণ্ডপের বাম পাশে অবস্থিত প্রতিমার পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন অখিল রায়চৌধুরী।
ইতিহাসের পাতা ওল্টালে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে মুর্শিদাবাদের দহপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন রায় পরিবারের সদস্য শশীকান্ত রায়। মা কালীর সাধক শশীকান্ত একবার কামাখ্যায় সাধনা করতে যান। ওই পরিবারের সদস্যদের মতে, সেখানেই তাঁর পরিচয় হয় তন্ত্রসাধিকা কুন্ডলা মায়ের সঙ্গে। কিছুদিনের মধ্যেই কুণ্ডলা মা এবং শশীকান্তের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয়। তারপর তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং একসঙ্গে বাস করার সিদ্ধান্ত নেন।
শোনা যায়, শশীকান্ত যখন কামাখ্যা থেকে দহপাড়ায় নিজের গ্রামে ফিরে আসছিলেন সেই সময় গঙ্গার পাড়ে তিনি একটি পাথরের দুর্গা মূর্তি কুড়িয়ে পান। এর কিছুদিনের মধ্যেই মা দুর্গা, শশীকান্তকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, যাত্রাপথের তৃতীয় দিন তিনি যেখানে পৌঁছবেন সেখানেই যেন মা দুর্গাকে স্থাপন করেন। দেবীর আদেশ অনুযায়ী দুর্গা মূর্তি কোলে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশে রওনা দেন শশীকান্ত এবং তাঁর স্ত্রী কুন্ডলা মা। যাত্রা শুরুর তৃতীয় দিন পশলা গ্রামে গম্ভীরা নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পাথরের দুর্গামূর্তি এতটাই ভারী হয়ে উঠেছিল যে তা কোলে বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তখন তাঁরা সেই দুর্গামূর্তি সেখানেই নামিয়ে রাখেন এবং তখন থেকে সেখানে শুরু হয় মা দুর্গার পুজো।
রায় পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, শশীকান্ত রায়ের এই পুজোর কথা যখন নবাব আলীবর্দী খান জানতে পারেন, তখন তিনি শশীকান্তকে ১৬০টি গ্রাম উপহার দেন এবং গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কর বাবদ যে টাকা আদায় করা হবে তা দিয়ে তিনি পুজো সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। এইভাবে ধীরে ধীরে শশীকান্ত ওই অঞ্চলের জমিদার হয়ে ওঠেন। সেই সঙ্গে তিনি বিশাল একটি দুর্গা মন্দির স্থাপন করে সেখানে জাঁকজমক সহকারে দুর্গা পুজো শুরু করেন।
যদিও বর্তমানে তাঁর শুরু করা পুজোর পাশাপাশি তাঁরই কাকার দুই ছেলের দু'টি আলাদা দুর্গা প্রতিমা ওই একই মণ্ডপে পুজো করে থাকেন। তবে দুর্গা প্রতিমার পুজোর দায়িত্ব আলাদা ব্যক্তিদের হাতে থাকলেও দর্শনার্থীদের কাছে তিন প্রতিমার এই দুর্গাপুজো অন্যতম আকর্ষণ।
শশীকান্ত রায়ের পরিবারের এক সদস্য জানান, 'প্রাচীন রীতিনীতি মেনে আজও এই তিনটি দুর্গা প্রতিমার পুজো হয়ে থাকে এখানে। এমনকি জাঁকজমকতারও কোনও খামতি রাখি না আমরা।' তিনি আরও বলেন, 'নিয়ম মেনে ষষ্ঠীর দিন ভোরবেলা তিনটি পরিবার নিকটবর্তী দিঘিতে কলসিতে জল ভরতে যায়। প্রথমে 'মা বুড়ি'র জন্য জল নেওয়া হলে বাকি দু'টি প্রতিমার জন্য জল নেওয়া হয়। এমনকি সন্ধি পুজোর সময় হাজারখানেক পরিবার হাড়িতে করে 'মা বুড়ি'র কাছে ভোগ নিবেদন করেন। পুজো শেষে পরিবারের মহিলারা সেই প্রসাদ খেয়ে তাঁদের উপবাস ভাঙেন।'
রায় পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরনো রীতি মেনে আজও এখানে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে পুজো করেন পুরোহিত। দেবীর উদ্দেশ্যে বলি প্রথা এখানে এখনও চালু রয়েছে। তাছাড়া এই পুজোকে কেন্দ্র করে বিশাল মেলা বসে পাশলা গ্রাম জুড়ে। দশমীর দিন কাঁধে করে বেহারারা তিনটি প্রতিমাকে নিরঞ্জনের জন্য ডিহি দিঘির ঘাটে নিয়ে যান। দিঘিতে প্রথমে 'মা বুড়ি'র প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। তারপর বাকি দু'টি প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয় ডিহি দিঘির জলে।