হিংসা এখন অতীত, সামশেরগঞ্জের সমস্ত ধর্মের মানুষ শামিল হলেন দুর্গাপুজোর আনন্দে ...
আজকাল | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
শ্রেয়সী পাল: মাত্র কয়েক মাস আগেকার ঘটনা।ওয়াকফ বিল সংশোধনী আইন প্রত্যাহারের দাবিতে হিংসার আগুনে পুড়েছিল মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ থানা এলাকার ধুলিয়ান পুরসভার একাধিক ওয়ার্ড সহ জাফরাবাদ, রানীপুর , ডিগ্রী, বেতবোনা, পালপাড়ার মতো একাধিক গ্রাম।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আগুন নিভে গিয়েছে। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব এবং পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতায় ফের একবার দুর্গাপূজোর আনন্দে মেতে উঠেছে সামশেরগঞ্জবাসী। রবিবার সকালেই নিয়ম মেনে বোধন হয়েছে জাফরাবাদ , বেতবোনা এবং রানীপুর সহ একাধিক গ্রামে দুর্গাপুজোগুলোর। পুজোর দিনগুলোতে সামশেরগঞ্জে যাতে শান্তি এবং সম্প্রীতি বজায় থাকে তা সুনিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত ওয়াকাফ বিল সংশোধনী আইন প্রত্যাহারের দাবী ঘিরে সামশেরগঞ্জে যে আন্দোলন হয়েছিল তাদের দু'জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন এবং গৃহহীন হয়েছিল প্রায় ৫০০ পরিবার। তবে গৃহহীনরা অধিকাংশই বর্তমানে নিজেদের বাড়িতে ফিরে এসেছেন।
সামশেরগঞ্জ থানার এক আধিকারিক জানিয়েছেন, ধুলিয়ান পুরসভা এবং সংলগ্ন ন'টি পঞ্চায়েত এলাকাকে আমরা সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারিতে মুড়ে ফেলেছি। ধুলিয়ান পুরসভা এলাকায় ছাড়াও সংলগ্ন পঞ্চায়েতের পাকুড় রোড এবং ফরাক্কা যাওয়ার রাস্তা পুরোপুরি সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারিতে আনা হয়েছে। তার ফলে এই এলাকায় অপরাধ করে কেউ পালিয়ে যেতে পারবে না। গোটা এলাকা 'সিসিটিভি সার্ভিলেন্সে' আনা হয়েছে।
এর পাশাপাশি ন'টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যেকটি প্রান্তকে সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারিতে আনা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। কিন্তু সেখানকার 'ক্যামেরার ফিড' কেন্দ্রীয় মনিটরিং রুমে আনা এখনও সম্ভব না হওয়ায় প্রত্যেকটি গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি গোপন জায়গায় 'ডিভিআর' রেখে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, সামশেরগঞ্জের পরিস্থিতির স্বাভাবিক রাখার জন্য এখনও সেখানে তিন কোম্পানি বিএসএফ এবং আরও তিন কোম্পানি কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর জাওয়ানরা নিয়মিত টহলদারি করছেন। এর পাশাপাশি রাজ্য পুলিশের আরও এক কোম্পানি র্যাফ জওয়ানরা রয়েছেন। দুর্গাপুজোর দিনগুলোতে সকলেই শান্তিতে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতে পারবেন বলে নিশ্চিত পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা।
সামশেরগঞ্জ থানার ওই আধিকারিক আরও জানান, এবছর থানা এলাকায় একশোর বেশি পুজো কমিটিকে রাজ্য সরকারের আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছরের মত বেতবোনা গ্রামে একটি, জাফরাবাদ গ্রামে দু'টি এবং রানীপুর গ্রামে একটি দুর্গাপুজো হচ্ছে। এর পাশাপাশি পুরসভা এলাকার ১৬ এবং ১০ নম্বর ওয়ার্ডে যে পুজোগুলো হতো সেখানেও স্বাভাবিকভাবেই দুর্গাপুজোগুলো হচ্ছে।
তবে একাধিক পুজো কমিটির কর্তারা জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার পুজো করার জন্য আর্থিক অনুদান না দিলে এবছর সামশেরগঞ্জের একাধিক পুজো কমিটি পুজো চালানোর ক্ষেত্রে বড় সমস্যায় পড়তেন। কারণ হিসেবে তাঁরা জানিয়েছেন, অশান্তির আগুনে যে গ্রামগুলো পুড়ে গিয়েছিল সেখানে এখনও সবকিছু স্বাভাবিক হয়নি। মানুষের হাতে তেমনভাবে টাকা-পয়সাও নেই। তার ফলে দুর্গাপুজোর চাঁদা উঠছে না।।
কাঞ্চনতলা ঘোষপাড়া দুর্গাপুজো কমিটির সম্পাদক মিলন ঘোষ বলেন,' সামশেরগঞ্জে এখনও কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকায় আমরা নিশ্চিন্তে দুর্গাপুজো করতে পারছি। তবে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে সেই অনুপাতে আমাদের চাঁদা উঠছে না। এখানকার জৈন, আগারওয়াল সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের ব্যবসা সামশেরগঞ্জের অশান্তির পর অনেকটা কমে গিয়েছে। আমরা এবছর তেমনভাবে চাঁদা তুলতে পারিনি।'
ধুলিয়ান পুরসভা এলাকার বাসিন্দা তথা ফরাক্কার বিধায়ক মনিরুল ইসলাম বলেন ,'ধুলিয়ান বরাবরই সম্প্রীতি এবং ঐক্যের শহর। এখনও উৎসবের সময় অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ আমাকে নতুন পোশাক এবং মিষ্টি পাঠান। একটা অঘটন এখানে হয়েছিল কিন্তু সেটা আমরা কাটিয়া উঠেছি। এখানে এখন আর মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই। সকলে আজ থেকে পুজোর আনন্দে শামিল হয়েছেন। ' তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত ধুলিয়ান পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান সুমিত সাহা বলেন,' দুর্গাপূজোর আনন্দ যাতে সকলে করতে পারেন তা সুনিশ্চিত করার জন্য পঞ্চমীর সন্ধেতে ধুলিয়ান পুরসভার তরফ থেকে বেতবোনা, পালপাড়া ,দাসপাড়া এলাকায় যে সমস্ত মানুষ গৃহহীন হয়েছিলেন তাঁদেরকে চাল, ডাল এবং অন্যান্য খাদ্যশস্য বিতরণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি মহিলা এবং পুরুষদেরকে শাড়ি এবং ধুতি দেওয়া হয়েছে।' তিনি বলেন ,'সামশেরগঞ্জ থানা এলাকায় মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের , বাকি ১৫ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। আমরা একে অন্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে চলেছি। আগামীদিন ব্যবসা-বাণিজ্য যত বাড়বে ততই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাসের যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল তা কমতে থাকবে।' পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান জানান, তাঁর নিজের ছ'নম্বর ওয়ার্ডে এবছর ন'টি দুর্গাপুজো হচ্ছে এবং সবগুলোই বেশ জাঁকজমক করে হচ্ছে।