সংবাদদাতা, রামপুরহাট: রামপুরহাটের মুসলিম অধ্যুষিত বনহাট গ্রামের দুর্গাপুজোর পিছনে রয়েছে কয়েকশো বছরের ইতিহাস। জৌলুস কিছু কমে এলেও মুঘল আমলের এই পুজো বংশ পরম্পরায় চালিয়ে আসছেন বেনে পরিবার। পুজোর রীতি ও নিষ্ঠা আজও অটুট। সবচেয়ে বড় কথা বেনে বাড়ির সদস্যদের দাবি, এই পুজোয় অষ্টমীতে এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও উপবাস রাখেন। মনস্কাম পূরণে মানত করেন দেবীর কাছে।
রামপুরহাট থেকে দুমকা যাওয়ার রাস্তার ধারে জঙ্গলে ঘেরা বনহাট গ্রাম। মুসলিম প্রধান এই গ্রামে মাত্র ৩৫ টি হিন্দু পরিবারের বাস। গ্রামে পুজো বলতে একটিই বেনে বাড়ির পুজো। এই পুজো কবে শুরু হয়েছিল তা পরিবারের কাছে অজানা। ২০০৪ সালে বাড়ি পরিষ্কারের সময় বেশ কিছু পুঁথি উদ্ধার হয়। তা থেকেই বেনে বাড়ির সদস্যরা জানতে পারেন, ১১৮৯ সনে অধুনা বাংলাদেশ থেকে আসা তৎকালীন জমিদার পুজোর আয়োজক ধরমদাস চৌধুরির নিষ্ঠা দেখে তাঁকে প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন। পুঁথি ঘেঁটে পরিবার যেটুকু জানতে পেরেছে, মুঘল আমল থেকে এই পুজো হয়ে আসছে। যা রামপুরহাট মহকুমার মধ্যে প্রাচীন একটি পুজো। তবে বহু পুঁথির ভাষা এখনও উদ্ধার হয়নি। সেই সময় জমিদারির কিছু অংশ দান করা হয়েছিল। সেই অংশের আদায়কৃত খাজনায় পুজোর জাঁকজমক বেড়েছিল। পরবর্তীকালে, ধরমদাসের একমাত্র ছেলে মুকুন্দলাল দাস চৌধুরি পুজোর দায়িত্বভার নেন। এরপর বংশ পরম্পরায় রামরঞ্জন দাসচৌধুরি, উমাশংকর দাস এবং বর্তমানে কৃষ্ণদুলাল দাস এই পুজো চালিয়ে আসছেন। তখন মাটির চালাঘরে দেবীর আরাধনা হলেও এখন মায়ের পাকা মন্দির হয়েছে।
ষাটোর্ধ্ব কৃষ্ণদুলালবাবু বলেন, এখানে মা চান না তাঁর পুজো ভাগ হয়ে যাক। তাই তো বংশ পরম্পরায় আমাদের একটি করে পুত্রসন্তান। তাঁর কথায় , দাদুর সময় একবার আর্থিক দুরাবস্থা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু পুজো বন্ধ হয়নি। বাপ ঠাকুরদার চিরাচতির রীতি মেনে বৈষ্ণব মতে পুজো হয়ে আসছে। এই দেবী খুবই জাগ্রত। মূর্তি গড়া যেমনই হোক না কেন, বেদীতে বসার পর মা নিজেই মূর্তি ধারণ করেন। যা এককথায় অলৌকিক। মা এখানে মৃন্ময়ী। সন্তানদের সঙ্গে নিয়েই আসেন তিনি। বেনেবাড়ির পুজো হলেও ঘট ভরার সময় স্থানীয় পুকুর ঘাটে দোলা নিয়ে যান গ্রামের ব্রাহ্মণ সন্তান। শোভাযাত্রায় শামিল হয় গ্রামের মুসলিমরাও। একইভাবে নিরঞ্জনেও অংশ নেন তাঁরা।
কৃষ্ণদুলাল বাবু আরও বলেন, অনেক মুসলিম পরিবার অষ্টমী পুজোর দিন উপবাসে থাকেন। এখানে তাঁরা মানতও করেণ। বছর খানেক আগে বিশ্বভারতী থেকে পুঁথিগুলি সংগ্রহের জন্য এসেছিল। কিন্তু আমরা সেগুলি নিজেদের কাছেই সযত্নে রেখেছি। কৃষ্ণদুলাল বাবুর ছেলে অমিত দাস বলেন, পুজোর চারদিন এই মন্দির চত্বর সম্প্রীতির মিলনস্থল হয়ে ওঠে। গ্রামের বেশিরভাগ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও এখানকার দেবী দুর্গার মাহাত্ম্য তাঁদের আকৃষ্ট করে। এই পুজো এলাকায় সম্প্রীতির অন্যতম নিদর্শন।