• দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে বাংলায় বর্গি হানার স্মৃতি, ভোগে নিবেদন করা হয় কাঁচা কুমড়ো, পটল, ঝিঙে
    বর্তমান | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • প্রদীপ্ত দত্ত, ঝাড়গ্ৰাম: বর্গি হামলার সময় মন্ত্রপাঠ, ঢাকঢোল, কাঁসর বাজিয়ে দুর্গাপুজো করা যেত না। একচালা দেবী দুর্গার সামনে রেকাবিতে কাঁচা কুমড়ো, পটল, কাঁচকলা ঝিঙে ও আঁশযুক্ত মাছ সাজিয়ে দেওয়া হতো। সেইসঙ্গে ডালিতে তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা ও সুগন্ধী মশলা দেওয়া হতো। চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি মানুষের অবয়বের পিটুলি শত্রুরূপে বলি হয়। পূর্ববঙ্গ থেকে ঝাড়গ্রামে চলে আসা শতাব্দীপ্রাচীন সেন ও দাশগুপ্ত পরিবারের পুজোর প্রথায় আজও কোনও বদল হয়নি।

    সময়টা ১৭৫৪সাল। বঙ্গের রাজনৈতিক আকাশে তখন দুর্যোগের কালো মেঘ। বর্গিরা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে হামলা শুরু করেছে। গ্ৰামে গ্ৰামে লুট, হানাহানি চলছে। পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরের ব্রাহ্মণ-দৌলতপুর গ্ৰামেও তার আঁচ এসে পড়েছিল। গোপনে গ্ৰামের বর্ধিষ্ণু সেনগুপ্ত পরিবারের দুর্গাপুজো করা শুরু হয়েছিল। দেবীর প্রতিমার সামানে কাঁচা শাকসবজি, আঁশযুক্ত মাছ ও মশলাপাতি সাজিয়ে দেওয়া হতো। বাড়ির সদস্যরা দুর্গা মণ্ডপের উঠানে ছাগ বলি দিতেন। বাম হাত দিয়ে প্রতীকী শত্রু বলিরও প্রথা ছিল। দেশভাগের সময় আবার পারিবারিক বিপর্যয় নেমে আসে। পরিবারের সদস্যরা এক কাপড়ে এপার বাংলায় চলে এসে আশ্রয় নেন। সর্বশেষে ঝাড়গ্রামে এসে পৌঁছন। ছিন্নমূল পরিবারের সদস্য জ্ঞানেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ১৯৪৮সালে ঝাড়গ্রামের বাছুরডোবায় পারিবারিক দুর্গাপুজা শুরু করেন। সেই পুজো এখনও হয়ে চলেছে। পরিবারের দু’টি শাখা সেনগুপ্ত ও দাশগুপ্ত পরিবারের সদস্যরা প্রথা ও রীতিনীতি মেনে এখন পুজো করেন। পঞ্চমীতে পুজোর সূচনা হয়। পারিবারিক প্রথা মেনে আজও দেবীকে কাঁচা শাকসবজি, আঁশযুক্ত মাছ উৎসর্গ করা হয়। ছাগ বলি বন্ধ হওয়ার পর আখ, চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। নবমীতে  চালের পিটুলির মানুষের অবয়বের ছোট মূর্তি বাম হাত দিয়ে বলি দেওয়া হয়। দশমীতে চালের গুঁড়ো, গন্ধরাজ লেবুর রস মিশ্রিত সরবত দেবীকে দেওয়া হয়। তারপর বিসর্জন পর্ব শুরু হয়। একচালায় দেবী দুর্গার প্রতিমার ডানদিকে থাকেন লক্ষ্মী, কার্তিক বামে সরস্বতীর সঙ্গে গণেশ। দেবীর পুত্র-কন্যার এই দিক বদলের কারণ পরিবারের সদস্যরা জানেন না। শাস্ত্রমতে অবশ্য এই বদলে কোনও ত্রুটি নেই বলেই তাঁরা জানাচ্ছেন। 

    পরিবারের বর্তমান সদস্য দীপঙ্কর সেনগুপ্ত বলেন, ফরিদপুর ও ঝাড়গ্ৰাম মিলিয়ে আমাদের পুজো সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন। দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গ থেকে আমাদের পরিবার ঝাড়গ্রাম চলে আসে। বাড়ির নথিপত্রে উল্লেখ আছে বর্গি হামলার সময় ধুমধাম করে পুজো করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুজোর আয়োজন করাও কষ্টসাধ্য ছিল। দেবীকে তাই কাঁচা শাকসবজি ও মাছ দিয়ে আরাধনা 

    করা হতো।
  • Link to this news (বর্তমান)