সোহম কর, কলকাতা: তিরিক্ষি মেজাজে সূর্যদেব একেবারে মধ্যগগনে। তবে সেই রোদের তেজ শহরের সড়ক খুঁজছে স্পর্শ করার জন্য। কারণ, রাস্তাজুড়ে শুধুই মানুষ আর গাড়ির সমারোহ। ষষ্ঠী যে এসে গিয়েছে। আর বৃষ্টি? আগুনের শিখার ধোঁয়ার মতো উধাও। মানুষের সারি দেখে বেহালার রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধা আকাশের দিকে জোড়হাত করে বললেন, ‘মন থেকে চাইলে সব পাওয়া যায়। কেমন রোদ উঠেছে!’ দুপুরে যে ভিড় শহরজুড়ে বাঁধ ভেঙেছিল, সূর্য অস্ত যেতেই তা যেন জনসুনামি।
বিকেল ৫টা নাগাদ দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের ঠাকুর দেখে হু হু করে মানুষ প্রবেশ করছেন ত্রিধারার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ ব্যারিকেডের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকার পর আর অপেক্ষা করা গেল না। ঠেলেঠুলে এগিয়ে গেলেন মানুষ। পুলিশ আর কীই বা করতে পারে! জনসুনামিতে সবুজ সিগন্যালের সামনেই দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি-বাস। যদিও দর্শনার্থীরা এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়াননি। শুধু দুপুরের দিকে বহু মণ্ডপ ঘুরে ক্লান্ত দর্শনার্থীরা খুঁজে নিচ্ছিলেন খাবারের দোকান। সেখানেও যে লাইন। বিরিয়ানি নাকি চিলি চিকেন-চাউমিন? অনেকের বক্তব্য, ‘এখন অনেক হাঁটতে হবে। তাই দুপুরে হালকা খাওয়াই ভালো।’ পেটে কিছু পড়তে না পড়তেই পরের মণ্ডপে কীভাবে যাওয়া যায়, তার তোড়জোড়। এদিকে প্রবল গরমে যে মেকআপ গলে যাচ্ছে! ঘেঁটে যাচ্ছে কাজল! তাই একটু ফাঁকা পেলেই, ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরায় দেখে মেকআপ ঠিক করে নেওয়া। মাঝেমধ্যে আবার দোকানে ঢুঁ মেরেও কসমেটিক্স কেনাকাটিও চলছে। আর পুজোয় অনন্ত পথ হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমধ্যেই বেইমানি করছে নতুন কেনা জুতো। শহরজুড়ে কিন্তু মণ্ডপের আশপাশে জুতো সেলাইয়ের জন্য বসে রয়েছেন অনেকেই। আর পায়ে ফোসকা পড়লেই ব্যান্ডএড।
যাঁরা একটু বেশি সাবধানী, সঙ্গে ছাতা রেখেছিলেন, তাঁদের এদিন কটাক্ষর মুখেই পড়তে হল। মাইকে কিশোর কুমারের সুর আর ঢাকের বাদ্যি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে ভেঁপুর আওয়াজে। শ্রীভূমি দেখে বাসে বসেই ‘আগে নাকতলা না একডালিয়া?’ ‘বালিগঞ্জ স্টপ থেকে গুগল ম্যাপে একডালিয়া টেন মিনিটস দেখাচ্ছে’। পাশ থেকে আর এক বন্ধুর বক্তব্য, ‘এই ক্রাউডে কি টেন মিনিটসে যাওয়া যাবে?’ তবে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আলোচনার অবকাশ নেই উত্তর কলকাতায়। কারণ শ্যামবাজার, হাতিবাগান মিলিয়ে উত্তরের শহর এদিন শুধুই মানুষের হাঁটা দেখেছে। টালা প্রত্যয়, বাগবাজার, কলেজ স্কোয়ার, কাশী বোস লেন, চালতা বাগান—কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। এদিন সন্ধ্যায় বাগবাজারের নীলাভ মণ্ডপের বাইরে শুধুই মানুষের মাথা। মাছিদেরও প্রবেশে যদি কোথাও বেগ পেতে হয়ে থাকে, তাহলে তা লেকটাউনের শ্রীভূমি এবং মধ্য কলকাতার সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার। এদিন শহরজুড়ে কলকাতা পুলিশ বাহিনীও একেবারে তত্পর ভূমিকায় ছিল। শহরের প্রতিটা মূল এলাকায় পর্যাপ্ত পুলিস। কিন্তু দর্শনার্থীদের সঙ্গে বচসা কিছুতেই এড়ানো যায়নি। এদিকের রাস্তা বন্ধ, ওদিক দিয়ে যেতে হবে—একথা বললেই আনন্দে ভেসে যাওয়া দর্শনার্থীরা একেবারে তেড়েফুঁড়ে উঠছিলেন। ঠান্ডা মাথাতেই সামলেছে পুলিস। তবে গড়পড়তা দর্শনার্থীদের বক্তব্য ছিল একটাই, ‘পঞ্চমী আর ষষ্ঠী ভালোমতোই কেটেছে। আর দু’টো দিন আবহাওয়াটা ভালো থাকুক। আর কিছু চাই না।’ যদিও ওই সামান্য বৃষ্টি নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চায় না বাঙালি। উত্সবে আনন্দ করা এখন মানুষের কাছে একপ্রকার অধিকারের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে।
আর যাঁরা কোনও কারণে এ বছর কলকাতায় আসতে পারলেন না, তাঁদের জন্য তো বন্ধুরা থাকলই। ম্যাডক্স স্কোয়ারের মাঠে বসে বিদেশের বন্ধুকে ভিডিও কলে রেখেই জমল আড্ডা। প্রাণের উত্সবে আনন্দের হাসাহাসির এই তো সবে শুরু।