• হাটখোলার দত্ত বাড়ির পুজো যেন স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবন্ত দলিল! নেতাজির সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
    আনন্দবাজার | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম ঐতিহ্যবাহী হল নিমতলা স্ট্রিটের হাটখোলা দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজো। এই পুজো কেবল একটি পারিবারিক উৎসব নয়, বরং বাংলা তথা ভারতের সমাজ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল।

    সূচনা ও প্রতিষ্ঠাতা

    ঐতিহ্যবাহী এই দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল ১৭৯৪ সালে। এর সূত্রপাত করেন জগৎরাম দত্ত। তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাটনা শাখার দেওয়ান এবং আন্দুলের দত্তচৌধুরী পরিবারের উত্তরসূরি। জগৎরাম দত্ত সেই সময়ে তাঁর ৭৮, নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের প্রাসাদোপম ভদ্রাসন নির্মাণ করে এই দুর্গোৎসব শুরু করেন।

    প্রতিমা ও পুজোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য

    দত্ত বাড়ির প্রতিমায় রয়েছে সাবেক বাংলা রীতির ছাপ এবং বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। যেমন -

    সাজ ও চালচিত্র: প্রতিমাকে পরানো হয় ডাকের সাজ। চালচিত্রটি হয় মঠচৌড়ি শৈলীর, যেখানে মাটির অলঙ্করণে আঁকা থাকে কৃষ্ণলীলা ও চণ্ডীর কাহিনি।

    দেবীর বাহন: দেবীর বাহন সিংহটি এখানে ঘোটক আকৃতির (ঘোড়ার মতো শরীর ও ড্রাগনের মতো মুখ)। যা দুর্গা প্রতিমার ক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায় না।

    ভোগ: এই পরিবারটি বৈষ্ণব হওয়ায় পুজোয় জীববলি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অষ্টমীতে ক্ষীরের পুতুল বলি দেওয়ার রীতি রয়েছে, যা কাপড় দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়। পুজোয় অন্নভোগ হয় না, বরং ভোগে থাকে নানা ধরনের মিষ্টি ও ভাজাভুজি। যার মধ্যে ঘিয়ে ভাজা লুচি ও বাটা চিনি (চিনিগুঁড়ো) অপরিহার্য। পুজোর সব কাজ ব্রাহ্মণরা করেন।

    সিঁদুর খেলা: অন্যান্য বাড়ির মতো বিজয়া দশমীতে নয়, এই বাড়িতে মহাষ্টমীর দিন সিঁদুর খেলা অনুষ্ঠিত হয়।

    স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নেতাজির যোগসূত্র

    হাটখোলা দত্ত বাড়ির পুজোয় এক সময় দেশাত্মবোধের আবেগ মিশে গিয়েছিল। স্বদেশি আন্দোলনের সময়কালে এই পরিবার দেবী দুর্গাকে দেশমাতা বা দেশমাতৃকা রূপে পুজো করত। এই বাড়িতে সেই সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ভিড় করতেন এবং গোপন সভাও বসত বলে শোনা যায়।

    সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হল, হাটখোলা দত্ত পরিবারের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠতা। জানা যায়, নেতাজির মা প্রভাবতী দেবী নাকি একটা সময় এই বাড়ির পুজোয় আসতেন। সেই ভিত্তিতে নেতাজিরও এই পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা ছিল।

    বিসর্জন শেষে দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার এক বিশেষ রীতি এই পুজোকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেছে। শোনা যায়, এক সময় পরিবারের এক পূর্বপুরুষ প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে ফেরার পথে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'বঙ্গ আমার জননী আমার' গানটি গেয়ে উঠেছিলেন। তাই, আজও বিসর্জন শেষে বাড়ির ছেলেরা সমবেত কণ্ঠে গঙ্গার ঘাট থেকে এই গানটি গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরেন এবং শূন্য ঠাকুর দালানের সামনে গানটি গেয়ে আলিঙ্গন ও শান্তির জল গ্রহণ করেন।

    এই সমস্ত ঐতিহ্য আর ইতিহাসের বাঁধনে উত্তর কলকাতার হাটখোলা দত্ত বাড়ির পুজো আজও এক গৌরবময় অধ্যায় বহন করে চলেছে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)