অবিশ্রান্ত বর্ষার পর যখন শরৎ আসে, প্রচণ্ড শীতের পর আসে বসন্ত। এই দুই ক্ষেত্রেই প্রকৃতির রোষের পর দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আরাধানা হয়। বসন্তকালে ‘বাসন্তী’ ও শরৎকালে ‘মা দুর্গা’। এই দুই ক্ষেত্রেই প্রকৃতির রোষের পর ভারতবাসী তখন পূর্ণ উদ্যোগে আর উৎসাহে জাগিয়া ওঠে।। তবে শরৎকালের দুর্গার আরাধনা বহুল প্রচলিত বাংলার বড় পূজা নামে খ্যাত। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম ও ত্রিপুরা সহ ভারতের সর্বত্রই এই উৎসব পালিত হয়। কিন্তু ব্যায় বহুল হওয়ার জন্যে এই দুর্গা পূজা এক সময় রাজা-মহারাজা বা জমিদারের দ্বারা পূজিত বা পরিচালিতা হত। ইতিহাস বলে বাংলায় প্রথম দুর্গা পুজো হয় পনেরো শতকে।
কথিত আছে দিনাজপুর এবং মলদার জমিদাররা প্রথম দুর্গা পুজো করেন। লোককাহিনি অনুসারে জানা যায় রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ অথবা নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার প্রথম অকালবোধন করেন ১৬০৬-এ জনশ্রুতি কংসনারায়ণ ব্যায় করেছিলেন আট লক্ষ টাকা। বারোয়ারী পুজোর সূচনা হয়েছিল সম্ভবত গুপ্তিপাড়ায়। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে বারোজন বন্ধু মিলে গুপ্তিপাড়ায় জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো দেখার জন্য হাজির হলেন। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় পুজোমণ্ডপে প্রবেশ করতে পারিলেন না। পরের বৎসর এই ‘বারোজন ইয়ার বা বন্ধু মিলে’ দুর্গাপুজো করেন যা ‘বারোয়ারী’ পূজা নামে খ্যাত। আর কলকাতায় ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘বারোয়ারী’ পূজার কৃতিত্ব। কাশিমবাজারের রাজা হরনাথ নন্দীর। পরবর্তীকালে ঘরে ঘরে যা ‘সার্বজনীন’। দুর্গোৎসব নামে পরিচিত।
আঠারো শতকের শেষ এবং বিশশতকের শুরুতে শহরের দুর্গাপুজোর চরিত্র পাল্টে গেল। বনেদি ধনীর আলয়ে সুসজ্জিত ঠাকুর দালান থেকে দেবী দুর্গার বারোজনের মাঝে নেমে আসা। যিনি দেশ ও জাতির সঙ্কটে হয়ে উঠেন উদ্ধারকর্ত্রী রূপে। তাই তিনি ‘দুর্গোতিনাশিনী মা দুর্গা’। দেবী মর্তে এসে গয়না পরতেন, এই ছিল সাবেক জনশ্রুতি। সে গয়না আসত প্যারিস-জার্মান প্রভৃতি দেশ থেকে ‘ডাক মারফত’ যা কালক্রমে ‘ডাকের সাজ’ নামে খ্যাত। দুর্গাপুজোয় জমিদার বা বনেদি বাড়ির একচেটিয়া অধিকার যখন খসে পড়লো ‘বারোয়ারী’ পুজোর আবির্ভাব। পরিবর্তন দেখা দিল দুর্গা প্রতিমার সাজ সজ্জায়। প্রতিমা সাজানো হতো শোলার সাজ ও ডাকের সাজ। জলায় যে শোলা উৎপন্ন হয় তার সাদা অংশ দিয়ে তৈরি ভূষণে সজ্জিত-প্রতিমাকে বলা হত শোলার সাজের প্রতিমা। আর রাংতা যে সজ্জা হত তাকে বলা হত ডাকের সাজ। রাংতা আসতো জার্মান থেকে পাঠানো হতো ডাক মারফতে। তাই বলা হতো ‘ডাকের সাজ’ বর্তমানে দেশীয় প্রথার মালাকার দ্বারা প্রস্তুত করা সাজ্জাই ‘ডাকের সাজ’ নামে পরিচিত। বর্তমানে নদিয়ায়, কলকাতার কুমারটুলি ও চন্দননগরে এই ডাকের সাজ উল্লেখযোগ্যভাবে যোগ্যতার স্থান পেয়েছে।
মা দুর্গা তাঁর চার ছেলে মেয়ে নিয়ে একচালায় স্থান পেয়ে পুজিত হয়ে আসছিল এতদিন, একচালা ভেঙে পাঁচচালায় হলো প্রথম ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে। মা দুর্গার এই সংসার ভেঙে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ইচ্ছা করে নয়, বাধ্য হয়ে ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসু হলেন কুমারটুলির সর্বজনীন পুজো কমিটির সভাপতি। কিন্তু পঞ্চমীর দিন ঘটে গেল মহা অঘটন, মণ্ডপে চলে এসেছিল একচালা প্রতিমা। হঠাৎ বিকালের দিকে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গেল প্রতিমা সমেত গোটা পুজোমণ্ডপ। সুভাষচন্দ্র ছুটলেন মৃৎশিল্পী ‘গোপেশ্বর’ পালের কাছে। অনুরোধ করলেন গড়ে দিতে হবে প্রতিমা রাতারাতি। শিল্পী আকাশ থেকে পড়লেন এ কি করে সম্ভব। উপায় বাতলে দিলেন সুভাষচন্দ্র। দুর্গা ও তাঁর ছেলে মেয়েদের গড়তে হবে স্বতন্ত্র চালায় পৃথকভাবে। গোপেশ্বর গড়বে দুর্গার মূর্তি। অন্য চার শিল্পীরা চার দেব-দেবীর। সুভাষচন্দ্রের পরামর্শে অসাধ্য সাধন করলেন গোপেশ্বর এবং চার সহযোগী শিল্পীরা। পাঁচচালার দুর্গা প্রতিমা তৈরি হল এক রাতেই। পর দিন অর্থাৎ ষষ্ঠীতে নতুন প্রতিমা এল মণ্ডপে। দুর্গা ও তাঁর ছেলে মেয়ে পাঁচজনে পাঁচ চালায়। সেদিনের পর থেকেই কলকাতায় এবং গ্রাম বাংলায় শুরু হলো পাঁচচালা দুর্গা প্রতিমা।
শেষ করার আগে আমার নিজস্ব ধারণা সেকালে জমিদাররা দুর্গা পুজো করতেন তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখানোর জন্যে। একালে কাজটা করেন রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের ভাবমূর্তি সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে। সেই পুরানো ভাবধারা থেমে যায়নি। বহিরাঙ্গ বদলে গিয়েছে মাত্র।