আজকাল ওয়েবডেস্ক: বেহালার দুর্গাপুজোয় এ বছর শিল্পীরা এক অন্য রকম প্রতিবাদের ভাষা বেছে নিয়েছেন। তাঁদের প্যান্ডেল যেন কেবল শিল্পসৌন্দর্য নয়, বরং যুদ্ধবিরোধী আর্তি এবং ক্ষুধার্ত মানুষের বেঁচে থাকার কাহিনি। মণ্ডপের মূল বিষয়বস্তু গাজায় চলমান গণহত্যা ও পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ— যা বিশ্বমানবতার অন্যতম ভয়াবহ সংকট হিসেবে উঠে এসেছে। শিল্পীদের সরল বার্তা: “ফ্রি প্যালেস্তাইন”।
শিল্পীদের বক্তব্য, গাজার এই মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ অনেকটা মিল খুঁজে পায় বাংলার ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সঙ্গে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি যেমন লক্ষাধিক মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল, আজ একইভাবে ইজরায়েল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয়ে খাদ্যরসদ আটকিয়ে প্যালেস্তাইনের সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। শিল্পী রাজনারায়ণ সন্ত্রা বলেন, “যেমন সময়ে চিত্তপ্রসাদ ও জয়নুল আবেদিন ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি এঁকে প্রতিবাদ করেছিলেন, তেমনি আমরাও আজ brush এবং sculpture দিয়ে প্রতিবাদ করছি।”
প্যান্ডেলে প্রবেশ করতেই দর্শনার্থীদের স্বাগত জানায় গাজায় জন্ম নেওয়া কবি নামা হাসানের কবিতা “Face to Face”। কবিতাটি পাঠ করা হচ্ছে প্যালেস্তাইনি নাট্যশিল্পী রায়েদা ঘাজালেহ-র কণ্ঠে। হাসান বর্তমানে সাত সন্তান নিয়ে আল-মাওয়াসির এক তাঁবুতে দিনযাপন করছেন। তিনি সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ ও শিল্পচর্চার মাধ্যমেই যুদ্ধকে প্রতিরোধ করছেন। শিল্পী প্রদীপ দাস জানান, তিনি ঘাজালেহর সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচিত, তাঁর মাধ্যমেই হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়। কবি নিজে এই শিল্প-প্রতিবাদের ভাবনা জেনে অনুমতি দিয়েছেন।
প্রবেশপথ তৈরি হয়েছে মানুষের পাঁজরের কাঠামো দিয়ে, যা দুর্ভিক্ষে মানুষের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা বোঝাতে প্রতীকী রূপ পেয়েছে।ভেতরে ছাদের ওপর থেকে ঝুলছে চালভর্তি বস্তা চেপে ধরা বিশাল বল-প্রেস যন্ত্র, যেন খাদ্য মজুদের ভয়ঙ্কর নিদর্শন। দুর্গা প্রতিমা ও তাঁর পরিবার থেকে ঝলমলে আভা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে — যেন দেবতাদেরও ছুঁয়ে গেছে দুর্ভিক্ষের ছায়া। এক কোণে ভাঙা যুদ্ধবিমানের প্রতিরূপ রাখা হয়েছে, তার চারপাশে স্তূপ করে রাখা চালের বস্তা। প্রাচীর জুড়ে ছাপচিত্রে জীবন্ত হয়ে উঠেছে ছিত্তপ্রসাদ ও জয়নুল আবেদিনের ক্ষুধার্ত মানুষের মুখ। ফাঁকা রাজকীয় আলমারি তুলে ধরেছে ব্রিটিশ শাসনের সময় বাংলার শোষণ ও লুট।
এমনকি এক বিশেষ ভেন্ডিং মেশিনে সাজানো হয়েছে ক্যানজাত পানীয়র মতো অস্ত্রশস্ত্র, যা যুদ্ধব্যবসার নগ্ন চেহারাকে প্রকাশ করে।প্রবেশমুখে শোভা পাচ্ছে জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উক্তি—“All the war-propaganda, all the screaming and lies and hatred, comes invariably from people who are not fighting. ”অন্য প্রান্তে একদিকে লেখা “Genocide”, অন্যদিকে স্পষ্ট স্লোগান “Free Palestine”।
প্রদীপ দাস বলেন, “আমরা জানি ঝুঁকি নিয়েছি। সরকারের অবস্থান একরকম হলেও শিল্পীরা যদি চুপ করে থাকেন, তবে তাঁদের শিল্পী বলা যায় না।” রাজনারায়ণ সন্ত্রা যোগ করেন, “শিল্পীদের প্রতিবাদ সীমান্তের মধ্যে আটকে থাকতে পারে না। ২০২১-এ যেমন রিহানা বা গ্রেটা থুনবার্গ ভারতের কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আজ আমরা গাজার মানুষের পাশে দাঁড়ালাম।” প্যান্ডেলে আসা অনেকেই জানিয়েছেন, সাধারণ পুজো মণ্ডপে এত গভীর রাজনৈতিক ও মানবিক বক্তব্য আগে দেখেননি। শিল্পীরা শুধু দেবী দর্শনের আঙ্গিকে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং যুদ্ধবিরোধী আর্তিকে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আয়োজনে মিশিয়ে দিয়েছেন।