বাইসারান হত্যাকাণ্ড, স্বাভাবিকতা আর কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ...
আজকাল | ০১ অক্টোবর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২২ এপ্রিল পাহেলগামে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু কাশ্মীরকে ফের একবার রক্তাক্ত স্মৃতিতে ফিরিয়ে দেয়। এদিন শ্রীনগর থেকে জম্মু যাওয়ার পথে খবর পান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ। জম্মু পৌঁছনোর আগেই নিহতের সংখ্যা একে একে বেড়ে দাঁড়ায় ২৬। পরে দিল্লি থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ফোনে কথা বলেন তাঁর সঙ্গে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ওমর ফেরেন শ্রীনগরে।
হামলার পরেই কেন্দ্র ‘অপারেশন সিন্ধূর’ চালায়, এয়ার ফোর্সের মিসাইল হামলায় ধ্বংস হয় জইশ-ই-মহম্মদ ও লস্কর-ই-তইবার সদর দফতর। কিন্তু সেই ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে ওমরের বক্তব্য, “২২ এপ্রিলের বাইসারান হত্যাকাণ্ড ছিল কাশ্মীরের উপর এক কালো মেঘ। যারা পর্যটকদের কালমা পড়তে বাধ্য করেছিল, তাদের লক্ষ্য ছিল সাম্প্রদায়িক সংঘাত উসকে দেওয়া।”
এবারের ঘটনাটি নিয়ে সাধারণ কাশ্মীরিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। অতিথিদের রক্ত ঝরানোকে তারা প্রকাশ্যে নিন্দা করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর “মন কি বাত”-এ এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের কোনও উল্লেখ হয়নি। বরং, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাশ্মীরি ছাত্র-ছাত্রী ও পেশাদারদের হেনস্থার ঘটনা ঘটে। নিহত পর্যটক হিমাংশি নারওয়ালের স্ত্রী যখন বলেছিলেন “কাশ্মীরিদের আক্রমণ করবেন না”, তখন তাঁকেই নিশানা করা হয়।
ওমরের মতে, এ এক বিরাট সুযোগ ছিল কেন্দ্রের জন্য – কাশ্মীরিদের আস্থা ফেরানোর। কিন্তু “সুযোগ হাতছাড়া করাই কাশ্মীরের চিরন্তন ট্র্যাজেডি। সবাই কাশ্মীর নিয়ে কথা বলে, কিন্তু কাশ্মীরের সঙ্গে কথা বলে না।”
হামলার পরে একদল সংবাদমাধ্যম দাবি তোলে যে পর্যটন ব্যবসায়ীরা অনুমতি ছাড়াই বাইসারান খোলেন। এই অভিযোগের জবাবে ওমর সমস্ত সরকারি নথি খতিয়ে দেখে বলেন, “গত বছর লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহার সরকার বাইসারানকে টিকিটেড ডেস্টিনেশন হিসেবে তিন বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ করে। এক ব্যবসায়ী বছরে এক কোটি টাকার বিনিময়ে সেই অধিকার পান। বছরে আট-ন’মাস বাইসারান খোলা থাকত। ৫০,০০০ পর্যটক ইতিমধ্যেই ২২ এপ্রিলের আগে সেখানে গিয়েছেন। অনুমতি ছাড়া খোলা হলে প্রশাসন ঘুমোচ্ছিল?”
ওমর প্রশ্ন তোলেন— হামলার দিন কেন কোনও নিরাপত্তা বাহিনী বাইসারানে মোতায়েন ছিল না? কেন গোয়েন্দা সংস্থার কোনও তথ্য মেলেনি? তাঁর বক্তব্য, “কাশ্মীরকে জোর করে ‘স্বাভাবিক’ বলে চালিয়ে দেওয়া প্রশাসনের আত্মতুষ্টি তৈরি করেছে ভয়ঙ্কর ফাঁক।”
আরও এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে যখন সুপ্রিম কোর্ট আর্টিকেল ৩৭০ বাতিলের রায় বহাল রাখলেও বিচারপতি সঞ্জয় কিশন কৌল প্রস্তাব দেন একটি নিরপেক্ষ ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠনের – যাতে ১৯৮০-এর দশক থেকে আজ পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত হয়।প্রাক্তন র’ প্রধান এ এস দুলতও ২০২৩ সালে মত দিয়েছিলেন, “মোদী যদি শ্রীনগরে গিয়ে রাজ্য মর্যাদা পুনঃস্থাপনের ঘোষণা করেন, তবে আর কখনও তাঁকে নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে ঘুরতে হবে না।” সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যেও মতভেদ নেই। লেফটেন্যান্ট জেনারেল দুয়া ও হুডা—দু’জনেই বলেছেন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ছাড়া আস্থা ফেরানো সম্ভব নয়। সেনাকে সীমান্তে রাখা যেতে পারে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ এলাকায় ধীরে ধীরে সরানো উচিত।
অতীতের উরি (২০১৬) ও পুলওয়ামা (২০১৯)-এর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কিংবা সাম্প্রতিক অপারেশন সিঁদুর— কোনওটিই স্থায়ী সমাধান আনতে পারেনি। ওমরের মতে, “কাশ্মীরকে স্বাভাবিক বলা যায় না। স্বাভাবিকতা তৈরি করতে হয়, আর তা সম্ভব নয় জনগণকে সঙ্গে না নিলে।”আজও কাশ্মীর এক আবেগঘন সঙ্কটে দাঁড়িয়ে। একদিকে পাকিস্তান-বিরোধী মনোভাব প্রবল, অন্যদিকে দিল্লির প্রতি আস্থা নড়বড়ে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আব্দুল্লাহর কথাতেই ধরা পড়ে ক্ষোভ ও দৃঢ়তা: “পাকিস্তান কখনও কাশ্মীর পাবে না, হাজার বছর চেষ্টা করলেও না।”কাশ্মীরের ভবিষ্যতের শেষ শব্দ এখনও লেখা হয়নি। হয়তো আমাদের জীবদ্দশায়ও লেখা হবে না। কিন্তু একথা পরিষ্কার— সংখ্যার হিসাবে পর্যটকের ভিড় নয়, মানুষের আস্থা ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েই কাশ্মীরের শান্তি ও স্থিতিশীলতার মাপকাঠি নির্ধারণ হবে।