কাশির সিরাপ খেয়ে রাজস্থানে মৃত দুই শিশু, ওই ওষুধ ঠিক প্রমাণ করতে গিয়ে বেহুঁশ চিকিৎসকও!...
আজকাল | ০২ অক্টোবর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: রাজস্থান সরকারের জন্য এক ওষুধ কোম্পানির তৈরি একটি জেনেরিক কাশির সিরাপ খেয়ে গত দুই সপ্তাহে রাজ্যে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে কমপক্ষে ১০ জন।
কায়সন ফার্মা নামক একটি কোম্পানি তৈরি ডেক্সট্রোমেথোরফান হাইড্রোব্রোমাইড যৌগ ধারণকারী কাশি সিরাপের কিছু ব্যাচের বিপদ সোমবার প্রকাশ পায়, যখন ওষুধটি দেওয়ার কয়েক ঘন্টা পরেই পাঁচ বছরের একটি ছেলে মারা যায়।
রাজস্থানের সিকার জেলার ৫ বছর বয়সী নীতিশের কাশি এবং সর্দি লেগেছিল। রবিবার তার বাবা-মা ছেলেকে চিরানার কমিউনিটি হেল্থ সেন্টারে (সিএইচসি) নিয়ে যান। ডাক্তার কাশি সিরাপটি লিখে দেন এবং নীতিশের মা রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ ছেলেকে সেই ওষুধ দিয়েছিলেন। নীতীশের মায়ের দাবি, ছেলে ভোর ৩টায় ঘুম থেকে উঠে হেঁচকি তুলতে তাকে, জল দিলে সে ফের ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর আর ঘুম থেকে ওঠেনি।
সোমবার সকালে পাঁচ বছর বয়সী শিশুটিকে আতঙ্কিত বাবা-মা সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলেও মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
নীতীশের কাকা প্রিয়কান্ত শর্মা বলেন, "নীতীশ সেদিন ঠিক ছিল এবং সন্ধ্যায় নবরাত্রির অনুষ্ঠানের জন্যও গিয়েছিল। রাতে যখন সে আবার কাশি শুরু করে, তখন ওকে চিরানা সিএইচসি থেকে আনা ওষুধ দেওয়া হয়। সকালে আমরা বুঝতে পারি যে ছেলে ঘুম থেকে উঠছে না। তখনই ওকে সঙ্গে সিএইচসি-তে নিয়ে যাই। সেখানকার কম্পাউন্ডার আমাদের ছেলেকে সিকারের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। তাকে নির্ধারিত ডোজ দেওয়া হয়েছিল এবং ওষুধ খাওয়ার আগে সে ঠিক ছিল।"
আগের মর্মান্তিক ঘটনা
এই সপ্তাহে যখন নীতীশের খবর ছড়িয়ে পড়ে, তখন ২২ সেপ্টেম্বর কাশির সিরাপ খাওয়ার পর মারা যাওয়া ২ বছর বয়সী এক শিশুর বাবা-মাও বুঝতে পারেন যে ছেলের মৃত্যুর কারণ কী।
ভরতপুরের উপকণ্ঠে অবস্থিত মালহা গ্রামে সংবাদ মাধ্যমের একটি দল ছেলেটির পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তারা জানিয়েছে যে, ২ বছর বয়সী সম্রাট জাটভ, তার বোন সাক্ষী এবং খুড়তুতো ভাই বিরাট, সকলেই এই মাসের শুরুতে কাশি এবং সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছিল। তার মা, জ্যোতি, ২২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়েছিলেন এবং তাকে কেসন ফার্মার তৈরি একই কাশি সিরাপ খাওয়ানো হয়েছিল।
জ্যোতি দুপুর ১.৩০ মিনিটে সম্রাট, সাক্ষী এবং বিরাটকে সিরাপটি দিয়েছিলেন এবং পাঁচ ঘন্টা পরেও তিন সন্তানের কেউ না ঘুম থেকে ওঠায় পরিবারটি খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। পরে তারা সাক্ষী এবং বিরাটকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিল। কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই দু'জনে বমি করে। তবে সম্রাট অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।
দুই বছর বয়সী শিশুটিকে দ্রুত ভরতপুরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারপর জয়পুরের জে কে লন হাসপাতালে রেফার করা হয়, যেখানে ২২ সেপ্টেম্বর সে মারা যায়।
সম্রাটের ঠাকুমা নেহনি জাটভ বলেন, "আমার তিন নাতি-নাতনি সিরাপ খেয়েছিল এবং আমরা জানতাম না যে এটি মারাত্মক হতে পারে। তাদের মধ্যে দু'জন অবশেষে কয়েক ঘন্টা পরে জেগে ওঠে, কিন্তু আমি ২ বছর বয়সী সম্রাটকে হারিয়ে ফেলি... সিকার জেলার ছেলে এবং এর কারণে অন্যদের অসুস্থ হওয়ার খবর না পাওয়া পর্যন্ত আমরা জানতাম না যে সিরাপই এর কারণ।"
চিকিৎসকও অসুস্থ
পার্শ্ববর্তী বায়ানায়, ২৪শে সেপ্টেম্বর কাশির সিরাপ খাওয়ার পর ৩ বছর বয়সী গগন কুমার অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার মা কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ইনচার্জ, ডাঃ তারাচাঁদ যোগীর কাছে অভিযোগ করতে যান। ওই চিকিৎসকই পেসক্রিপসনে সিরাপটি লিখে দিয়েছিলেন।
একজন আত্মবিশ্বাসী চিকিৎসক যোগী তখন নিজেই সিরাপের একটি ডোজ নেন এবং অ্যাম্বুলেন্স চালক রাজেন্দ্রকেও দেন, যাতে প্রমাণ করা যায় যে এটি নিরাপদ। এরপর চিকিৎসক নিজের গাড়িতে ভরতপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু ঘুম ঘুম ভাব অনুভব করেন, রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখেন গাড়ি এবং অজ্ঞান হয়ে পড়েন। দীর্ঘক্ষণ ধরে কোনও খবর না পেয়ে, তাঁর পরিবার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। প্রায় আট ঘন্টা পরে গাড়ির কাছে এসে তাঁর পরিবার দেখেন চিকিৎসক গাড়ির মধ্যে পড়ে রয়েছেন।
সিরাপ দেওয়ার তিন ঘন্টা পরে অ্যাম্বুলেন্স চালকও একই রকম লক্ষণ প্রকাশ করেছিলেন এবং চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
গত সপ্তাহে, দক্ষিণ রাজস্থানের বাঁশওয়ারা জেলায় ওষুধ খাওয়ার পর এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী আট শিশুও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
সরকারি পদক্ষেপ
দুই শিশুর মৃত্যু এবং অন্যদের অসুস্থ হওয়ার খবর প্রকাশ পাওয়ার পর, রাজস্থান সরকার ২২টি ব্যাচের সিরাপ নিষিদ্ধ করেছে এবং তাদের বিতরণ বন্ধ করে দিয়েছে। চিকিৎসা বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, এই বছরের জুলাই থেকে রাজস্থানে রোগীদের ১.৩৩ লক্ষ বোতল সিরাপ দেওয়া হয়েছে।
জয়পুরের এসএমএস হাসপাতালেও ৮,২০০ বোতলেরও বেশি সিরাপ মজুদ রয়েছে, তবে কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে যে সেগুলি যেন কাউকে না দেওয়া হয়।
বাঁশওয়ারার মহাত্মা গান্ধী সরকারি হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. প্রদ্যুম্ন জৈন বলেন, "যে ওষুধের কারণে কিছু শিশুর শ্বাসকষ্ট বা ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অতিরিক্ত মাত্রা গ্রহণের ফলেও এই প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। বাঁশওয়ারায়, বেশিরভাগ শিশু চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠেছে। ৬ বছর বয়সী এক শিশুর অবস্থা গুরুতর ছিল, তবে সেও সুস্থ হয়ে উঠেছে।"
রাজস্থান মেডিকেল সার্ভিসেস কর্পোরেশন লিমিটেডের মান নিয়ন্ত্রণের নির্বাহী পরিচালক জয় সিং বলেন, "ডাক্তারদের ওষুধ বন্ধ করতে বলা হয়েছে।"