উৎসবের মরসুম শুরু হয়েছে দুর্গাপুজো দিয়ে। শহর সেজেছে নানা বাহারি আলোয়। মণ্ডপ থেকে আকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছে লেজ়ার আলো। শহরের রাস্তায় সিগন্যাল বা হোর্ডিংয়ের দৃশ্যমানতা বজায় রাখতে ছাঁটা হয়েছে গাছেরডালপালা। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে কাটা হয়েছে গাছ ও আগাছাও। এমন পরিস্থিতিতে বেজায় সমস্যায় পড়েছে এ শহরের পক্ষীকুল। আলোয় কোনও পাখির চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। কোনও পাখি গাছে বসতে পারছে না। কোনও কোনও পরিযায়ী পাখি এই সময়ে শহরের উপর দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে অন্যত্র।
এ শহরে পাখিদের আনাগোনা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের মতে, এই সময়ে পাখিরা শীতকালীন ঠিকানার খোঁজে যাত্রা শুরু করে। পাহাড়ে ঠান্ডা পড়তে শুরু করায় এ সময়ে সেখানকার কোনও কোনও প্রজাতির পাখি সমতলে নেমে আসে। কিন্তু এ বছর দুর্গাপুজো এগিয়ে এসেছে। শহরে উৎসবের পরিবেশ তৈরি করতে রাস্তার বিভিন্ন গাছে আলো লাগানো হয়েছে, ছাঁটা হয়েছে ডালপালা। তার জেরে কলকাতা শহরে পাখিরা আর নামতে পারছে না।
‘বায়োডাইভার্সিটি অব রবীন্দ্র সরোবর’ নামে একটি সংগঠনের সদস্যেরা পাখিদের গতিবিধির ছবি তোলেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, এই বছর শহরে আসা পরিযায়ী পাখির সংখ্যা অনেকটাই কম। তবে গঙ্গাসাগর, ডায়মন্ড হারবারের মতো তুলনায় দূষণমুক্ত জায়গায় ইতিমধ্যেই পরিযায়ী পাখির আনাগোনা শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনও শহুরে পরিযায়ীদের দেখা কলকাতায় খুব বেশি মিলছে না।
তাঁরা জানাচ্ছেন, কমলা দামা, নীল শ্যামা, শুমচা, গুপিগলা-সহ নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এ বছর খুবকমই চোখে পড়ছে। তার উপরে উৎসবকে কেন্দ্র করে শহরের আকাশে বিভিন্ন ভাবে যে পরিমাণ আলো জ্বলছে, তাতে এ সময়ে রাতচরা, লক্ষ্মী পেঁচা, কুটুরে পেঁচাদের মতো নিশাচর পাখিদের এক প্রকার বাঁচার লড়াই শুরু করতে হচ্ছে।
পক্ষীপ্রেমী সুদীপ ঘোষের কথায়, ‘‘শহরে পুজোর সময়ে ডালপালা ছেঁটে দেওয়ায় স্থানীয় পাখিদের আশ্রয়হীন হতে হয়। তার উপরে পাহাড় বা অন্যান্য জায়গা থেকে আসা বহু পরিযায়ী পাখি যাত্রাপথের মধ্যে এই শহরে নামে বিশ্রাম নিতে। তার পরে তারা ফের উড়ে গিয়ে তাদের পছন্দমতো শীত কাটানোর জায়গা খুঁজে নেয়।’’
উল্লেখ্য, কোনও গাছে কোনও রকম আলোকসজ্জা করা যাবে না বলে রায় দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। কিন্তু দুর্গাপুজোর পর থেকে বর্ষবরণ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে শহরের বহু এলাকা আলোয় সাজাতে গাছকেই মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
তার উপরে বিভিন্ন ধরনের উৎসবকে কেন্দ্র করে শহরে বিভিন্ন বিপণির বড় বড় বিজ্ঞাপনী বোর্ডও রাতে জ্বলজ্বল করে। যেখানে ধাক্কা খেয়ে বহু স্থানীয় পাখির মৃত্যু হয় বলেও জানাচ্ছেন পক্ষীবিদেরা। এ ছাড়া গাছ ছেঁটে দেওয়ায় পাখিদের বাসাও ভেঙে যাচ্ছে বলে অভিযোগ।
পক্ষীপ্রেমী তীর্থঙ্কর রায়চৌধুরী জানান, রবীন্দ্র সরোবর, সুভাষ সরোবর, বটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতরে অজস্র গাছগাছালি পাখিদের বাসা বা বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। তিনি বলেন, ‘‘এ বছর বাইরে থেকে আসা পাখির তিন-চারটির বেশি প্রজাতি এখনও চোখে পড়েনি। শহর জুড়ে আলোকসজ্জা বা এলইডি হোর্ডিংয়ের রমরমা। গাছ খুঁজতে গিয়ে হোর্ডিংয়ের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে হোর্ডিংয়েই ধাক্কা খেয়ে পাখিরা পড়ে যায়। এর পরে আসবেকালীপুজো ও দীপাবলি। তখন শব্দদূষণ আরও বাড়বে। প্রতি বছরই এই সমস্যা হয়ে থাকে। এটা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।’’
পরিবেশকর্মীদের পর্যবেক্ষণ, পিট্টা-সহ বেশ কিছু নতুন ধরনের পরিযায়ী পাখি শীতের কলকাতায় আজকাল আসছে। কিন্তু যে ভাবে আলোর দূষণে আকাশ ঢেকে যাচ্ছে, তাতে পাখিরা বাধ্য হচ্ছে তাদের পরিযানের পথ বদলাতে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান পুনর্বসু চৌধুরীর কথায়, ‘‘এখন পুজো মণ্ডপ থেকে আকাশের দিকে লেজ়ার আলো দেখানো হচ্ছে। এতে পাখিদের পরিযানের পথে বাধা তৈরি হচ্ছে। গোটাউৎসবের মরসুমে যত পরিমাণ আলো ব্যবহার হয়, তাতে বায়ুর সঙ্গে আলোর দূষণও তৈরি হচ্ছে। তার জেরে আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে না।আকাশের তারা পাখিদের পরিযানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি, এই আলোর দূষণ ফুল ফোটার ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি করছে। আমরা রাজ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগকে আমাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছি।’’