প্রায় তিন বছর ধরে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ‘প্যানেল বহির্ভূত’ অযোগ্য প্রার্থীদের অশিক্ষক পদে নিয়োগ করেছিলেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় এবং তৎকালীন স্কুল সার্ভিস কমিশনের উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিংহ। আলিপুর বিশেষ আদালতে নথি পেশ করে এমনই দাবি করল সিবিআই। ওই আদালতেই সম্প্রতি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির তিনটি মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ওই বিচার প্রক্রিয়ায় এসএসসি অর্থাৎ স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ দফতরের এক আধিকারিকের প্রায় ১৪ পাতার লিখিত বয়ান পেশ করেছেন মামলার তদন্তকারী অফিসার।
তদন্তকারীদের দাবি, একাধিক অফিসার ও ডেটা অপারেটরকে দিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী নিয়োগপত্র তৈরি করিয়েছিলেন কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়। প্রত্যেক অফিসারকে আলাদা করে নিজের ঘরে ডাকতেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি। কোনও লিখিত নির্দেশ তিনি জারি করতেন না। মৌখিক নির্দেশের ভিত্তিতে কাজ করানো হত। কোন অফিসারকে কত সুপারিশপত্র দেওয়া হয়েছিল তা অন্যদের জানতে দিতেন না কল্যাণময়। অফিসারেরা সুপারিশপত্র অনুযায়ী নিয়োগপত্র তৈরি করতেন এবং তা কল্যাণময়ের ঘরে জমা দিয়ে আসতেন। তারপর ওই সব নিয়োগ পত্র কী ভাবে বিলি করা হয়েছে, সেই বিষয়ে কিছু জানতেই পারতেন না।
লিখিত বয়ানে ওই সাক্ষীর দাবি, তাঁকে মাঝেমধ্যে নিজের ঘরে ডাকতেন কল্যাণময়। তারপর কখনও হাতে লেখা অযোগ্য প্রার্থীদের নামের তালিকা, আবার কখনও সিডিতে নামের তালিকা দিতেন কল্যাণময়। তাঁর মাধ্যমে প্রায় ৪০০টি প্যানেল বহির্ভূত অযোগ্য প্রার্থীর নিয়োগ পত্র তৈরি করিয়েছিলেন কল্যাণময়। তিনি ওই নিয়োগপত্র দফতরের কম্পিউটারে টাইপ করে তৈরি করেছিলেন এবং নির্দেশ অনুযায়ী কল্যাণময়ের ঘরে গিয়ে জমা দিয়েছিলেন। তবে কল্যাণময়ের দেওয়া হাতে লেখা এবং সিডির মাধ্যমে দেওয়া সুপারিশ পত্রের সব কপির ছবি তিনি তুলে রেখেছিলেন। পরে একটি পেনড্রাইভে ওই সব তথ্য রেখে দিয়েছিলেন।
লিখিত বয়ানে ওই সাক্ষীর আরও দাবি, কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির অনুসন্ধানে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত কমিটি তাঁকে তলব করেছিল। তিনি সমস্ত বিষয়টি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের জানিয়েছিলেন। পাশাপাশি ওই পেনড্রাইভের তথ্য কমিটির সদস্যদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
মামলার তদন্তকারী অফিসারের কথায়, একেবারে জঙ্গি নেটওয়ার্কের মতো অপারেশন। জঙ্গি গোষ্ঠীর মাথারা একাধিক জনকে দিয়ে একই রকম কাজ করায়। কিন্তু একজনের কাজ সম্বন্ধে আরেকজন যাতে কিছু জানতে না পারে সেই বিষয়ে নজর রাখে। যাতে পুরো পরিকল্পনা কোনও ভাবে ভেস্তে না যায়, সেই কারণেই বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করে জঙ্গি গোষ্ঠীর মাথারা। কল্যাণময় একাধিক অফিসারকে দিয়ে প্যানেল বহির্ভূত অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগপত্র তৈরি করিয়েছিলেন, কিন্তু মোট কত নিয়োগপত্র তৈরি হল এবং কাদের নিয়োগপত্র দেওয়া হল, সেই বিষয়টি সম্পর্কে সকলকেই অন্ধকারে রেখেছিলেন। ভবিষ্যতে যদি কোনও রকম তদন্ত হয়, তাহলে অভিযোগের সত্যতা কোনও ভাবেই যাতে প্রকাশ্যে না আসে, সে জন্য এমন ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন কল্যাণময়।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, এসএসসির মোট তিনটি আঞ্চলিক অফিস ছিল। বর্ধমান, মেদিনীপুর উত্তরবঙ্গে আঞ্চলিক অফিস এবং কলকাতায় প্রধান অফিস ছিল। তাঁদের দাবি, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এমন ভাবে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময় প্যানেল বহির্ভূত অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন কল্যাণময়। করুণাময়ীর একটি অফিস থেকে অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগপত্র হাতে তুলে দেওয়া হত।
কল্যাণময় ঘনিষ্ঠ তিন-চার জন অফিসার ওইসব নিয়োগপত্র অযোগ্য প্রার্থীদের হাতে তুলে দিতেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। কলকাতার অফিস থেকে নিয়োগপত্র নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসে যোগাযোগ করতেন অযোগ্য প্রার্থীরা। আঞ্চলিক অফিস থেকে বিভিন্ন স্কুলে অযোগ্য প্রার্থীদের গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হত।