দিনে-দুপুরে, রাত-বিরেতে বেজে ওঠে ফোন। ও’পার থেকে কারা যে কী সব বলে, তার বিন্দুবিসর্গ বোঝেন না তিনি! মাতৃভাষায় তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন। অন্য পারের মানুষ আবার তার কিছুই বোঝে না!
ফোন নিয়ে এমন যন্ত্রণাতেই প্রায় গড়িয়ে গিয়েছিল দু’বছর। কেরলের পালাক্কাডের নানা প্রান্তে ঘুরে ভিডিয়োগ্রাফির কাজ করা কার্তিকেয়ন দামোদরন ভাবতে শুরু করেছিলেন, এ জ্বালা থেকে তাঁর আর রেহাই মিলবে না বোধহয়। শেষ পর্যন্ত বিড়ম্বনা জর্জরিত কার্তিকেয়নকে স্বস্তি এনে দিলেন এই বঙ্গের দুই পরিযায়ী শ্রমিক!
বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাংলাদেশী বলে দাগিয়ে দিয়ে রাজ্যে রাজ্যে যখন পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থার ঘটনা সামনে আসছে, সেই সময়ে ভাষা এবং পরিযায়ী নিয়ে এ এক অন্য গল্প। যেখানে পরিযায়ীদের সৌজন্যে সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছেন ভিন্ রাজ্যের এক ভূমিপুত্র।
কাহিনির শুরু সেই ২০২৩ সালে। নবান্নে বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’ প্রকল্পের কথা। হেল্পলাইন নম্বর দিয়ে বলেছিলেন, এর মাধ্যমে সরকারি স্তরে অভিযোগ জানানো যাবে। ফোন করে কেউ কোনও সমস্যা বা অভিযোগের কথা জানালে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে নেওয়া হবে, তার পরে সরকারি আধিকারিকেরা বাকি ব্যাপার দেখে নেবেন। ‘দিদিকে বলো’ যেমন ছিল রাজনৈতিক, ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’ তেমন সরকারি প্রকল্প। কার্তিকেয়নের সমস্যা এখান থেকেই শুরু। ওই প্রকল্পের জন্য ঘোষিত নম্বরের একটা সংখ্যা কোনও ভাবে এ দিক-ও দিক হয়ে প্রচার হয়ে গিয়েছিল সমাজমাধ্যমে। তার পর থেকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নালিশ জানাতে এই বঙ্গ থেকে বহু মানুষ সেই নম্বর ডায়াল করেছেন, ফোন বেজে উঠেছে কেরলে কার্তিকেয়নের! কারণ, এক সংখ্যার তালে-গোলে ওই নম্বর কার্তিকেয়নের সঙ্গে মিলে গিয়েছে।
নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করে লোকজন সমস্যার কথা বলে গিয়েছেন বাংলায়, তার উত্তর দেওয়া হয়েছে মালয়ালমে! প্রথম প্রথম কার্তিকেয়ন ভেবেছেন, কেউ হয়তো তাঁর সঙ্গে মজা করছে। অনলাইন প্রতারণার যুগে এটা কোনও কৌশল হতে পারে আশঙ্কা করে কিছু নম্বর ‘ব্লক’ও করেছেন। তাতে পরিস্থিতি পাল্টায়নি। এক শুভানুধ্যায়ী মারফত শেষমেশ তাঁর যোগাযোগ হয়ে যায় মালমপুঝার বিধায়ক এ প্রভাকরনের সঙ্গে। কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকদের সন্তানদের মালয়ালম, হিন্দি ও ইংরেজিতে সড়গড় করানোর জন্য ‘রোশনী’ এবং পরিযায়ীদের কাজ চালানোর মতো মালয়ালম শেখাতে ‘চাঙ্গাতি’ নামে দু’টি সরকারি প্রকল্প রয়েছে। পালাক্কাডে এই রকমই একটি শিবিরে কার্তিকেয়নকে পাঠিয়েছিলেন বিধায়ক, যদি কোনও সুরাহা মেলে ভেবে। কাজ হয়েছে সেখানেই।
বাংলা থেকে গিয়ে কেরলে কর্মরত দুই পরিযায়ী শ্রমিক কার্তিকেয়নের ফোনে বার্তা এবং অডিয়ো-ভিডিয়ো দেখে বুঝে নিয়েছেন, যোগাযোগকারীরা আসলে ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’র কাছে পৌঁছতে চাইছেন! ওই নম্বর যে সেই নম্বর নয়, সেই গলদ বুঝিয়ে তাঁরা বাংলায় একটা ভিডিয়ো করে দিয়েছেন। এখন ওই ধরনের ফোন এলেই কার্তিকেয়ন সেই ভিডিয়ো ক্লিপ পাঠিয়ে দেন। সমাজমাধ্যমেও পোস্ট করে রেখেছেন। তার পরে ফোনের সংখ্যা একটু কমেছে!
সিপিএম বিধায়ক প্রভাকরনের কথায়, ‘‘ওই ব্যক্তি প্রথমে ভাবতেন, তাঁকে হয়রান করার জন্য কেউ হয়তো এমন করাচ্ছে। পরে ফোনে আসা একটা ভিডিয়ো দেখে তিনি বুঝতে পারেন, বিষয়টা গুরুতর। সেখানে দু’টি মেয়ের উপরে অত্যাচারের ছবি ছিল, তারা সাহায্য চাইছিল। যোগাযোগ হওয়ার পরে ওঁকে পরিযায়ীদের কর্মশালায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছে।’’ বিধায়ক জানাচ্ছেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এমন প্রকল্প বা তার হেল্পলাইনের কথা তাঁরও জানা ছিল না। তাঁর কথায়, ‘‘শুরুতে ওঁকে (কার্তিকেয়ন) আমরা বলেছিলাম, এই রকম গোলমাল হচ্ছে যখন, তা হলে নম্বরটা বদলে নিন। কিন্তু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, আধার কার্ডের সঙ্গে ওই নম্বরের সংযোগ আছে বলে তিনি রাজি হননি।’’