• শুধুই সিঁদুর নয়, মায়ের বিদায়বেলায় আবির খেলা! পুরুলিয়ায় নয়া ‘ট্রেন্ডিং’ ঘিরে শোরগোল
    প্রতিদিন | ০৩ অক্টোবর ২০২৫
  • সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: মায়ের বিদায়বেলায় মহিলাদের সিঁদুর খেলার রীতি বহু প্রাচীন। এর সঙ্গে কোনও পৌরাণিক কাহিনি জড়িয়ে আছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে শাস্ত্রীয় তাৎপর্য-র সেভাবে উল্লেখ মেলেনি। যোগ রয়েছে সমাজ সচেতনতার। দেবী দুর্গাকে ‘কন্যা’ রূপে দেখা হয়। তাই পুজো শেষে তিনি বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি ফিরছেন। তাকে সিঁদুর পরিয়ে যেন বলা হয় দাম্পত্য সুখী ও মঙ্গলময় হয়ে উঠুক। মূলত এই ভাবনাতেই বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে সিঁদুর খেলা চলে। কিন্তু এখন মায়ের বিদায়বেলায় অবিবাহিত মেয়েরাও সিঁদুর খেলছেন। এই সামাজিক আচারে জুড়ে গিয়েছেন পুরুষরাও। এ যেন ‘বিবর্তন’!

    কিন্তু মায়ের বিদায়বেলায় লাল-সবুজ আবির খেলা? এবার পুজোয় পুরুলিয়ায় যেন এটাই ট্রেন্ডিং। এখানকার সূর্য সেন পল্লি ষোলো আনা কমিটি শুরু করার পর তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য পুজো কমিটিতে। যদিও বেশ কয়েকটি পুজো কমিটি এই ট্রেন্ডিংকে বিদায়বেলার রীতি হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না। যাই হোক না কেন, সিঁদুরের সঙ্গে লাল- সবুজ আবিরে বৃহস্পতিবার মহাদশমীতে দুর্গার বিদায়বেলার উৎসব যেন আরও রঙিন হল পুরুলিয়ায়। দুর্গাপুজোয় যেসব রীতি রয়েছে তার মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে এই সিঁদুর খেলা। মূলত দেবীবরণের পরে বাঙালি গৃহবধূরা লাল সিঁদুরে একে অপরের সিঁথি রাঙিয়ে দেন। সিঁদুরের কৌটো মায়ের পা ছুঁইয়ে ষোলো আনা দক্ষিণা দেন। শাখা, পলা, নোয়ায় ছুঁয়ে দেন সিঁদুর।

    হিন্দু ধর্মে এই সিঁদুর শুধু প্রসাধন নয়। শক্তি, প্রেম, সৌভাগ্য, সংসার জীবনের প্রতীক। পৌরাণিক মতে সিঁদুর আসলে ব্রহ্মার প্রতীক। যিনি জীবনে মঙ্গল, সৃষ্টিশীলতা ও আনন্দ নিয়ে আসেন। মহিলাদের বিশ্বাস, সিঁথিতে সিঁদুর দিলে ব্রহ্মার অধিষ্ঠান হয়। অন্যদিকে
    মহাদশমী মানেই কষ্ট, দুঃখ, মাকে বিদায় দেওয়ার যন্ত্রণা। সেই কারণেই মহিলারা একে অপরের গলায়, গালে, সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে রাঙিয়ে খুশিতে মেতে ওঠার কথা বলেন। এই রীতি থেকে বার্তা একটাই, জীবন হোক রঙিন, মঙ্গলময় এবং মা দুর্গার মতো শক্তিশালী। তাহলে শারদীয় উৎসবের শেষ বেলায় আবির কেন? আবির তো শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার প্রেমলীলা উদযাপনে। তাছাড়া জয়কে স্মরণ করতে। বসন্তের আগমনে প্রকৃতির নতুন রূপের সাথে আনন্দ করতেও আবির খেলা হয়ে থাকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার মহাদশমীর ঘট বিসর্জনে পুরুলিয়া শহরের সূর্য সেন পল্লি ষোলো আনা কমিটির সদস্যরা একে অপরে লাল-সবুজ আবির খেলে রাঙিয়ে দিলেন। মায়ের বিদায়বেলায় দুঃখ দূর হয়ে যেন আনন্দে রঙিন হল। সিঁদুর ছাড়িয়ে লাল-সবুজ আবিরে মায়ের বিদায় বেলার যেন দুঃখ ঘুচল।

    পুরুলিয়া শহরের সূর্য সেন পল্লি ষোলো আনা কমিটির সম্পাদক উত্তম লাহিড়ী বলেন, “আবির খেলা সামাজিক ভেদাভেদ দূর করে। সম্প্রীতির বার্তা বহন করে। বর্তমান সময়ে যা পরিস্থিতি সেই সব কথা মাথায় রেখে তাছাড়া আমাদের এবার ২৫ বছর পূর্তি। এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আমরা দশমীর ঘট বিসর্জনে লাল-সবুজ আবির খেলেছি। মায়ের বিদায়বেলায় সিঁদুর খেলে যেমন কষ্ট লাঘব করা হয়। তেমনই আবির খেলে বিদায়বেলায় দুঃখ হ্রাস করলাম। তবে এটা ট্রেন্ডিং কিনা জানি না।”

    কিন্তু এদিন ঘট বিসর্জনে পুরুলিয়া শহরের সাহেব বাঁধে দেখা গেল ওই সূর্য সেন পল্লি ষোলো আনা কমিটির সঙ্গে অন্যান্য পুজো কমিটির সদস্যরাও আবির খেলে মেতে উঠেছেন। পুরুলিয়া শহরের দেশবন্ধু রোড সর্বজনীন পুজো কমিটির সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা তথা শিক্ষিকা নিকিতা কেশরী বলেন, “আমরা সিঁদুর খেলার রীতিতেই বিশ্বাসী। আমাদের ঘট বিসর্জনের সময় অন্যান্য পুজো কমিটির সঙ্গে আমরা মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায় আমাদের পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা উৎসাহের বশে আবির খেলেছে বটে। তবে আমরা এই উৎসবের শেষে সিঁদুর খেলার মধ্যেই থাকতে চাই। পুজোয় এটাই সামাজিক আচার।”

    পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায় বলেন, “দুর্গাপুজোর সময় আগে বিবাহিত মহিলারাই সিঁদুর খেলতেন। এখন অবিবাহিত মহিলারাও সিঁদুর খেলেন। কয়েক বছর ধরে দেখছি পুরুষ মানুষরাও সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেছেন। আবিরও তাই নতুন সংযোজন। আবির খেলার মধ্যে দিয়ে যে সামাজিক ভেদাভেদ দূর হয় এই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।” তবে লাল ও সবুজ আবিরে কিন্তু রাজনীতিও জড়িয়ে রয়েছে। লাল সিপিএম, সবুজ তৃণমূল। কিন্তু শারদীয় উৎসবে রাজনীতির রঙে প্রবেশ করতে চান না পুজো কমিটি থেকে সিঁদুর বা আবির খেলায় মেতে ওঠা পুরুলিয়া শহরের মানুষজন। তারা চান সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা দূর হোক। হোক অশুভ শক্তির বিনাশ। তা সিঁদুর হোক আবির!
  • Link to this news (প্রতিদিন)