• ২৪ সেপ্টেম্বরের সহিংসতার পর জনরোষে একঘরে দল
    আজকাল | ০৪ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: চোগলামসার রোডে দুপুরের খাবার নিতে পুলিশ ভ্যানের দিকে ছোটাছুটি করছেন রাজ তিলক নামে এক আধাসামরিক জওয়ান। তাঁর কাঁধে ঝোলানো বন্দুক, হাতে টিফিন বক্স। ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে বহুস্তরীয় নিরাপত্তায় ঘেরা ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দপ্তর। মাত্র এক সপ্তাহ আগের হিংসার  দাগ আজও স্পষ্ট—তিনতলা ভবনের অধিকাংশ জানালা ভাঙা, প্রবেশপথের দেয়ালে কালো কালির দাগ, চারদিকে নির্জনতা।

    দু’একটি গেরুয়া পতাকা আবার উড়ছে বটে, কিন্তু ভবনের ভেতরে নেই কোনো রাজনৈতিক কর্মীর উপস্থিতি। জওয়ান রাজ তিলক স্পষ্টই বললেন, “আমরাই কেবল আছি এখানে, আর কেউ নেই।” সংবিধানিক সুরক্ষা ও গণতান্ত্রিক অধিকার দাবিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হলেও ২৪ সেপ্টেম্বর তা রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী হিংসায়। কয়েকজনের মৃত্যু ও বহু আহতের ঘটনার পর থেকেই বিজেপি কার্যত জনরোষের মুখে।

    লেহ অটোনোমাস হিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের (LAHDC) ২৬ জন সদস্যের মধ্যে ১৫ জন বিজেপির হলেও তাঁদের অধিকাংশ এখন প্রকাশ্যে আসতে ভয় পাচ্ছেন। একাধিক কাউন্সিলর স্বীকার করেছেন যে তাঁরা ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। এক বিজেপি কাউন্সিলর জানালেন, “আমার আসলে রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। আমি ভেবেছিলাম মোদি–শাহ জুটি লাদাখের উন্নতির জন্য কাজ করবেন। কিন্তু যা হয়েছে, তা ঐতিহাসিক ভুল।”

    ২০১৯ সালে কেন্দ্র লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার পর ২০২০ সালের কাউন্সিল নির্বাচনে বিজেপি বিপুল জয় পায়। নির্বাচনী ইশতেহারে তারা লাদাখের ভূমি, চাকরি ও পরিবেশ রক্ষায় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পাঁচ বছর পরেও সেই প্রতিশ্রুতি অপূর্ণ। পরিবর্তে কেন্দ্র সরকার রেল ও বিদ্যুৎ খাতে বৃহৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা নিয়ে লাদাখিরা সন্দেহ করছেন যে তাঁদের জমি, সম্পদ ও জীবনধারাই বিপন্ন হচ্ছে।

    এক কাউন্সিলর বলেন, “সমস্যার বীজ রোপিত হয়েছিল সোনম ওয়াংচুকের পাঁচবারের অনশনের সময় থেকেই। কিন্তু কেন্দ্র বিকল্প কোনো রূপরেখা দেয়নি।” লাদাখ বিজেপি ইউনিটের অভ্যন্তরীণ কলহও প্রকাশ্যে এসেছে। বর্তমান প্রধান নির্বাহী কাউন্সিলর তাশি গ্যালসনকে লোকসভা প্রার্থী করার সিদ্ধান্তে ২০১৯-এর সাংসদ জাম্যাং সেরিং নামগিয়াল ও তাঁর অনুগামীরা উপেক্ষিত হন। চলতি বছর তাশি গ্যালসন খাচুকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি করা হলে বিভাজন আরও প্রকট হয়।

    ২০১৯ সালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণার পর থেকে কাউন্সিল কার্যত ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সমস্যার সমাধানে নির্বাচিত সদস্যদের বারবার আমলাদের কাছে ধর্না দিতে হচ্ছে। এক কাউন্সিলর বলেন, “নিজের এলাকায় একটা রাস্তা পর্যন্ত বানাতে পারি না।”হিংসার  পর কয়েকজন বিজেপি কাউন্সিলর পরিবার-পরিজন নিয়ে লেহ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, দলীয় দপ্তর আবার তৈরি হতে পারে, কিন্তু হারিয়ে যাওয়া প্রাণগুলো আর ফিরে আসবে না। লেহ এপেক্স বডির সহ-সভাপতি চেরিং দর্জে লাকরুক স্পষ্ট বলেন, “আমাদের চার দফা দাবির বিষয়ে কেন্দ্রের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি কোনো আলোচনাই করেনি। এখন প্রথম দাবি— গ্রেপ্তার  হওয়া সবাইকে মুক্তি দিতে হবে।”

    আসন্ন কাউন্সিল নির্বাচনের আগে বিজেপি কার্যত কোণঠাসা। অনেক সদস্য গোপনে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে নিরপেক্ষ তদন্তের আবেদন জানালেও প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। লাদাখ বিজেপির সভাপতি তাশি গ্যালসন খাচু মঙ্গলবার দাবি করেছেন, হিংসা প্ররোচিত করেছিলেন সোনম ওয়াংচুক। তাঁর কথায়, “চারজন নিরপরাধ মারা গিয়েছেন, অথচ যাঁরা প্ররোচনা দিয়েছেন তাঁরা লুকিয়ে রয়েছেন।”কিন্তু বাস্তবতা হলো—২৪ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর বিজেপি লাদাখে জনবিচ্ছিন্ন। একসময়ের জনপ্রিয় দল এখন জনরোষের আতঙ্কে আত্মগোপন করছে, আর পাহাড়ি মরুভূমির মানুষ মনে রাখছে সেই রক্তাক্ত দিনের স্মৃতি।
  • Link to this news (আজকাল)