একদিকে আদি ও নব্য গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে রাজ্য কমিটিতে দলীয় নেতৃত্ব বাছাইয়ে প্রবল বিরোধ, অন্যদিকে সাংগঠনিক মতদ্বন্দ্বের কারণে দলীয় নীতিনির্ধারণে সমস্যা। এই দুই কারণে পুরনো ও নব্য বিজেপির মধ্যে মারাত্মক বিরোধ দেখা দিয়েছে। ফলে পুরনো কর্যকর্তা শমীক ভট্টাচার্যকে দীর্ঘদিন ধরে রাজ্য সভাপতি নিয়োগ করা হলেও এখনও রাজ্য বিজেপির নতুন কমিটি গঠন নিয়ে মারাত্মক টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। দল কীভাবে পরিচালনা করা হবে, দলের রাজ্য কমিটিতে কাদের রাখা হবে, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে দলের রাজনৈতিক রণকৌশল ঠিক কী হওয়া উচিত এবং সেই দায়িত্ব কারা কারা সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করতে পারবেন, তা নিয়ে আদি এবং নব্য বিজেপির এই দড়ি টানাটানি চূড়ান্ত আকার নিয়েছে বলে দলীয় সূত্রের খবর। আর সেই কারণে তোলপাড় শুরু হয়েছে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে।
জানা গিয়েছে, বঙ্গ বিজেপির প্রভাশালী নেতা, বিধায়ক, সাংসদ ও জনপ্রতিনিধিরা প্রতিনিয়ত কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের অনুগামীদের কমিটিতে প্রাধান্য বাড়ানোর জন্য। এমনকি এইসব জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই আগামীতে গঠিত হতে যাওয়া রাজ্য কমিটিতে সরাসরি নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে বদ্ধ পরিকর।
প্রসঙ্গত, গত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্য বিজেপি ব্যাপক সাফল্য পাওয়ার পর নতুনদের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার প্রবণতা বাড়তে শুরু করে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বামেদের লোকজন রয়েছেন। এঁদের অধিকাংশই রাজনৈতিক মতাদর্শের চেয়ে রাতারাতি ক্ষমতালোভীদের সংখ্যায় বেশি ছিলেন বলে আদি বিজেপির একটি বড় অংশের অভিমত।
তবে এই যোগদান পর্ব চূড়ান্ত আকার নেয় ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে। এই সময়ে দেখা যায়, শাসকদল তৃণমূলে গুরুত্বহীন হয়ে পড়া বা বিভিন্ন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিদের ব্যাপকহারে আগমন ঘটতে থাকে। এরফলে তৃণমূলে এইসব দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের দল থেকে ছেঁটে ফেলে জনমানসে যেমন স্বস্তি বাড়তে থাকে, তেমনই বিরোধী দল বিজেপি দুর্নামের ভাগিদার হয়ে যায়। আর এটা নিয়েই বরাবরই আপত্তি ছিল আদি বিজেপির একটি বড় অংশের।
এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান রাজ্য রাজনীতিতে পুরনো বিজেপি দলের রাজনৈতিক রণকৌশল পরিবর্তন করতে চাইলেও প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দলে বেনো জলের মতো ঢুকে যাওয়া নব্য বিজেপির একটি বড় অংশ। তাঁরা চাইছেন, তাঁদের চিন্তাধারা দলের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে। এজন্য রাজ্য থেকে জেলা কমিটিতে তাঁদের প্রভাব বাড়াতে চাইছেন। আবার আদি বিজেপি চাইছে, রাজ্য ও জেলা কমিটিতে পুরনো নেতৃত্বের প্রভাব বাড়িয়ে রাজনৈতিক রণ কৌশলের পরিবর্তন আনতে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আদি বিজেপি নেতা বলেন, নতুন করে দলে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা প্রকাশ্যে এমনকি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এমনসব মন্তব্য করছেন, যাতে মানুষের মধ্যে হিংসা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আমরা জানি, সংখ্যালঘুরা আমাদের ভোট দেবে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের থেকে আমরা দূরে সরে যায়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কিছু নেতা ক্ষমতায় আসার জন্য রাজ্যের শাসদকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু মমতাকে ‘কাউন্টার’ করে আমাদের ক্ষমতায় আসা অসম্ভব। কারণ এভাবে মানুষের কাছে পৌঁছনো যায় না। বরং ক্ষমতায় এলে আমরা মানুষের জন্য উন্নয়নের কী কী কাজ করতে পারি এবং কোন কোন পথে রাজ্যের বর্তমান বেকারত্ব, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, পরিকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, তা মানুষকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর দরকার রয়েছে। কিন্তু এইসব নেতাদের এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনও ধারনা বা বৌদ্ধিক চিন্তাভাবনা নেই। এজন্য দল ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।
এরকম পরিস্থিতিতে শুক্রবার কলকাতায় এসে পৌঁছলেন দলের দুই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ভূপেন্দ্র যাদব ও বিপ্লবকুমার দেব। রাজ্য বিজেপির সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য ও প্রাক্তন সভাপতি সুকান্ত মজুমদারদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করার কর্মসূচি রয়েছে তাঁদের।
বিজেপি সূত্রে খবর, আগামী সাত মাস পর বাংলায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিধানসভা নির্বাচন। এই ভোটের জন্য বিজেপি ভূপেন্দ্র যাদবকে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক এবং বিপ্লবকুমার দেবকে সহকারী পর্যবেক্ষক হিসেবে মনোনীত করেছে। ২৫ সেপ্টেম্বর দলের তরফে তাঁদের নাম ঘোষণা করা হয়। ঘোষণার পর এদিনই প্রথমবার রাজ্যে এলেন তাঁরা। কলকাতা বিমানবন্দরে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান শমীক ভট্টাচার্য, প্রাক্তন সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক ও পুরুলিয়ার সাংসদ জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো।
দলীয় সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, দু’জন পর্যবেক্ষক প্রথমে শমীক ও সুকান্ত মজুমদারের সঙ্গে বৈঠক করবেন। পরবর্তী পর্যায়ে সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে বৈঠক করারও পরিকল্পনা রয়েছে। বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, ‘ভোট প্রস্তুতি নিয়ে কোনও সময় নষ্ট করা যাবে না।’ তাই বিজয়া দশমীর পরদিনই কার্যত নির্বাচনী কর্মসূচিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকরা।
এখন দেখার, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পাঠানো এই দুই পর্যবেক্ষক নীতিগত এবং গোষ্ঠীগত এইসব অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বঙ্গ বিজেপিকে কোনও দিশা দেখাতে পারেন কিনা।