• ভারতীয় মহিলা পেশাজীবীদের দ্বিতীয় ইনিংস...
    আজকাল | ০৪ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক:  কেটলির শিস বাজে। তিনি কাপ হাতে জানালার পাশে বসে একই পুরনো ইমেল খুলে দেখেন—যেটি বছরের পর বছর ধরে তাঁর রুটিনে পরিণত হয়েছে। কাজে স্থিতিশীলতা আছে, কিন্তু তাতে উত্তেজনা নেই।

    অন্যদিকে, বিয়ের পর অনেক নারী চাকরি ছেড়ে বাড়িতে থেকে সন্তান সামলাতে ও সংসার চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যাঁরা এখনও কাজ করেন, তারাও বিকেল ৫.৩০টার পর ল্যাপটপ বন্ধ করে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন এবং গৃহস্থালির নানা কাজে জড়িয়ে পড়েন।

    দশকের পর দশক ভারতীয় পরিবারে এই ছন্দই চলেছে—পুরুষদের জন্য পূর্বানুমেয় অফিসের রুটিন আর নারীদের জন্য তাড়াতাড়ি বিদায় ও যত্নসহকারে ভারসাম্য রাখা। স্থিতিশীলতাই ছিল প্রধান মূল্যবোধ। নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলা বরং মনে হতো ঝুঁকিপূর্ণ।

    কিন্তু সময় বদলাচ্ছে। এখন ৪০ বা ৫০ বছর বয়সী মানুষও নিজেকে নতুনভাবে ভাবছেন, নতুন দক্ষতা শিখছেন এবং একেবারে নতুন পেশায় নামছেন। কারণও পরিষ্কার—কাজের প্রকৃতি পাল্টেছে, আর মানুষ বুঝতে শিখেছে জীবনে “ভালো থাকা” মানে শুধু টাকা বা পদ নয়।

    নতুন করে ভাবার মুহূর্তমধ্যজীবন সবসময় সংকট আকারে আসে না, অনেক সময় তা এক ধরনের “ঠেলা” মাত্র। কেউ কেউ দেখেন প্রযুক্তি আর অটোমেশনে তাঁদের কাজের ধরন বদলে যাচ্ছে, কেউ আবার বুঝতে পারেন একই কাজ বারবার করতে করতে আর তৃপ্তি নেই।গ্লোবাল তথ্য বলছে, ৪৫–৫৪ বছর বয়সে পেশা বদলানো কর্মীরা গড়ে ৭.৪% বেশি আয় পান। এমনকি ৫৫–৬৪ বছর বয়সীদের মধ্যেও গড় আয় বৃদ্ধি প্রায় ৩.৫%। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যে উন্নতি ও কাজ–জীবনের ভারসাম্যও ভালো হয়। এই তথ্য ভারতীয়দেরও সাহস জোগাচ্ছে।

    কিন্তু ভারতীয় বাস্তবতায় পরিবার ও ভূমিকার প্রভাব বড়। পুরুষেরা প্রায়ই অভ্যস্ত রুটিন আঁকড়ে থাকেন, আর নারীরা সংসারের ভারে অনেক সময় কাজই ছেড়ে দেন। পরে নতুন করে শুরু করতে গেলে ভয় স্বাভাবিক।

    তবুও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আজ যে গল্প ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা আলাদা—একজন ম্যানেজার এখন কোচ, একজন গৃহবধূ এখন কাউন্সেলর, এক ইঞ্জিনিয়ার টেকসই উন্নয়ন কনসাল্টিংয়ে। প্রতিটি গল্পই পুরোনো ধারণাকে ভাঙছে।

    বিজ্ঞানও ব্যাখ্যা দিচ্ছে কেন মধ্যজীবনে পরিবর্তন যৌক্তিক। তরুণ বয়সে সাফল্য আসে দ্রুত সমস্যা সমাধান ও নতুনত্বে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় আলাদা শক্তি—জ্ঞান একত্রিত করার, অন্যকে শেখানোর, প্যাটার্ন খুঁজে বের করার ক্ষমতা। এগুলো নেতৃত্ব, শিক্ষাদান, কনসাল্টিং বা ডিজাইনের মতো কাজে দারুণ মানানসই। অর্থাৎ, মস্তিষ্কের দিকবদল এক সম্পদ, বোঝা নয়।

    পুনরায় কেরিয়ার শুরু মানে পুরোপুরি নতুন কিছু নয়। পুরনো অভিজ্ঞতার সঙ্গে নতুন ব্যবহারযোগ্য দক্ষতা মেলানোই আসল পথ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে—ডিজিটাল দক্ষতা, বিশ্লেষণী চিন্তা, সৃজনশীলতা ও ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স আগামী দিনের সেরা স্কিল। ভালো খবর হলো এখন নতুন করে শিখতে বড় ডিগ্রির দরকার নেই।

    সংক্ষিপ্ত কোর্স, মাইক্রো-সার্টিফিকেট বা সাপ্তাহিক প্রশিক্ষণ দিয়েই শুরু করা যায়। সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো “প্রোটোটাইপ” করা—অর্থাৎ ছোট্ট সাইড প্রজেক্ট নেওয়া, পার্টটাইম পড়ানো, স্বেচ্ছাসেবা করা বা স্বল্পমেয়াদি কনসাল্টিং করা। এগুলো থেকেই বোঝা যায় নতুন পেশা আসলেই মানাচ্ছে কিনা। ভারতের দ্রুত বাড়তে থাকা অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম এই কাজকে করেছে সহজ ও সাশ্রয়ী।

    ভারতের অর্থনীতি আজ অনেক সুযোগ দিচ্ছে—শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, টেকসই উন্নয়ন, কনসাল্টিং, তথ্যভিত্তিক কাজ ইত্যাদি। অভিজ্ঞতার সাথে আসা বিচক্ষণতাকে এখন নিয়োগকর্তারাও গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবুও বাধা আছে—বয়সভিত্তিক পক্ষপাত, নারীদের অদৃশ্য গৃহস্থালি শ্রম এবং পুরুষদের রুটিন আঁকড়ে থাকার অভ্যাস। পরিবার ভাগাভাগি করলে সহায়তা হয়—গৃহকর্ম ভাগ করা, নতুন দক্ষতা শেখার সময় দেওয়া বা নমনীয় কাজের সময় মানা অনেক সাহায্য করতে পারে। নারীদের জন্য পুনরায় শুরু মানে সময় ও অনুমতির প্রয়োজন। পুরুষদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো আরামের গণ্ডি ভাঙা। তাই সমমনা বন্ধু, মেন্টর ও নেটওয়ার্কই হতে পারে আসল শক্তি।

    মধ্যজীবনে কেরিয়ার পরিবর্তন মানে হঠাৎ বিপ্লব নয়। বরং এটি এক সচেতন নকশা—ছোট পরীক্ষা, সামান্য ব্যর্থতা আর ধীরে ধীরে জেতা। কৌতূহল থেকে শুরু করুন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন—আজ আপনার কাছে কী গুরুত্বপূর্ণ? নতুন দক্ষতা শিখুন, মেন্টর খুঁজুন এবং নিজের অভিজ্ঞতাকে ভবিষ্যতের গল্পে জুড়ে দিন। ভারতীয় পেশাজীবীদের জন্য ৪০ ও ৫০–এর দশক আর নামা নয়, বরং উর্বর জমি। সামান্য সাহস, সঠিক দক্ষতা এবং পরিবারের সহায়তা থাকলেই দ্বিতীয় ইনিংস হতে পারে অর্থপূর্ণ ও সমৃদ্ধ।
  • Link to this news (আজকাল)