• দার্জিলিঙে এক রাতের বৃষ্টি এবং ধসে মৃত অন্তত ১৭, সবচেয়ে বিধ্বস্ত মিরিক! ভাঙল বহু রাস্তা, সেতু
    আনন্দবাজার | ০৫ অক্টোবর ২০২৫
  • হাসিমারা উৎসব শেষ হয়নি। তার মধ্যে বিষাদ এবং আতঙ্ক গ্রাস করল উত্তরবঙ্গকে। ভয়াবহ দুর্যোগের মুখে পাহাড়। মাত্র এক রাতের ভারী বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত পুরো দার্জিলিং। ধসের কবলে একের পর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ পর্যন্ত ১৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, দার্জিলিঙের এমন ভয়াবহ রূপ শেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৯৮ সালে। তার পর ২৭ বছর বাদে এমন পরিস্থিতি তৈরি হল।\

    শনিবার রাতে বালাসন নদীর উপর দুধিয়ার লোহার সেতুর একাংশ বৃষ্টিতে ভেঙে যায়। এর ফলে শিলিগুড়ি এবং মিরিকের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সৌরেনির কাছে দারাগাঁওয়ে গভীর রাতে ধস নামে। একটি বাড়ি ধসে যায়। আপার দুধিয়া বা ডাম্ফেডার এলাকায় চার থেকে পাঁচটি বাড়ি ধসে গিয়ে জলের তলায় চলে গিয়েছে। বেশ কিছু হোমস্টে ছিল দার্জিলিঙের ওই অংশে। সেগুলোও ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুধিয়া নদীর একপাশে রয়েছে বিএসএফের ক্যাম্প। সেটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রবিবার সকালে প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মিরিক অঞ্চলে ৯ জন, সুকিয়াপোখরিতে ৭ এবং বিজনবাড়ি এলাকায় এক জনের মৃত্যু হয়েছে।

    ১০ নম্বর জাতীয় সড়কে ধস নেমেছিল শনিবার রাতে। দুপুরে অনেকাংশে তা মেরামত করা গিয়েছে। দার্জিলিঙে যাওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা পাঙ্খাবাড়ি রোডটি চড়াই-উতরাইয়ের জন্য পর্যটকেরা ব্যবহার করেন না। তবে এখন ওই রাস্তা দিয়েই পর্যটকদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঠিক কত জন পর্যটক পাহাড়ে আছেন, সরকারি ভাবে হিসাব মেলেনি। তবে এঁরা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটকে পড়েছেন।

    পুজোর সময় প্রচুর পর্যটক পাহাড়ে এসেছিলেন। পরিস্থিতি দেখে অনেকেই রবিবার বাড়ির রাস্তা ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সিংহভাগই আটকে রয়েছেন। বেশির ভাগ উড়ান বাতিল হয়েছে। অনেকে টিকিটই পাননি। পর্যটকদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে দুর্গম পথ এবং খারাপ আবহাওয়ার জন্য সবটাই হচ্ছে ধীর গতিতে। জিটিএ থেকে টাইগার হিল, রক গার্ডেনের মতো এলাকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এক দিনের জন্য। ত্রাণশিবির তৈরি হচ্ছে দার্জিলিঙের নানা জায়গায়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলির বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

    কালিম্পঙে একাধিক জায়গায় ধস নেমেছে। তবে দার্জিলিঙের তুলনায় এখানে ক্ষতির পরিমাণ কম। পরিস্থিতি দেখে গাড়ি চলাচলে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। সিকিম-পশ্চিমবঙ্গ সীমানায় এলাকাতেও ধস নেমেছিল। সেগুলো সারাইয়ের কাজ চলছে।

    জিটিএ প্রধান তথা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার শীর্ষ নেতা অনীত থাপার দাবি, কেবল মিরিক অঞ্চলেই ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন তিনি। অন্যান্য জায়গা থেকেও নানা দুর্ঘটনার খবর পাচ্ছেন। এমতাবস্থায় ত্রাণের কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘মিরিকের এসডিও, বিডিও থেকে (দার্জিলিঙের) সাংসদ, পুরসভার চেয়ারম্যান, ইঞ্জিনিয়ার— সকলেই কাজে নেমেছেন। সকলে সতর্ক থাকুন।’’

    দার্জিলিঙের সাংসদ রাজু বিস্তা জানান, দার্জিলিং এবং কালিম্পং জেলায় ভারী বৃষ্টিপাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাণহানি থেকে সম্পত্তির ক্ষতি, সরকারি পরিকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। তিনি সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘‘আমি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আমরা আমাদের বিজেপি কর্মীদের মানুষকে সাহায্য ও সহায়তার জন্য একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।’’

    অন্য দিকে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন সোমবারই তিনি উত্তরবঙ্গে যাবেন। শিলিগুড়ি থেকে তিনি গোটা বিষয়ের দেখভাল করবেন।

    স্থানীয়েরা বলছেন, অতিবৃষ্টি আগেও দেখেছে দার্জিলিং। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। এক রাতের বৃষ্টিতে দার্জিলিঙের এমন হালের জন্য তাঁরা দায়ী করছেন বালাসন নদী থেকে অবাধে পাথর, বোল্ডার লুট এবং একের পর এক নির্মাণকে।

    মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে দুপুরেই দুধিয়ায় পৌঁছে যান শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব এবং জেলাশাসক প্রীতি গোয়েল। তাঁরা জানান, দুধিয়ার যে সেতুর ক্ষতি হয়েছে, তার বিকল্প কোন রাস্তা করা যায় তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ অনেক সেতুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা আসছেন। তাঁরা এসে পরিকল্পনা করবেন।

    অন্য দিকে শিলিগুড়ির একাধিক জায়গা জলে প্লাবিত। বিশেষ করে পোড়াঝাড় এলাকায় মহানন্দা নদীর বাঁধ ভেঙে গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গ্রামবাসীদের অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়েছে।

    ক্ষতি ডুয়ার্সেও

    পাহাড়ের মতো ক্ষতিগ্রস্ত ডুয়ার্সও। শুলকাপাড়া এখন ডুবে রয়েছে। ভুটানে অতিবৃষ্টির ফলে সমগ্র ডুয়ার্সে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শনিবার বিকেল থেকে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে। বিশেষ করে দার্জিলিং, কালিম্পং কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়িতে টানা বৃষ্টি হয়েছে।

    উত্তরবঙ্গে আতঙ্ক

    রবিবার ভোর থেকে কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টিতে গোটা কোচবিহার জলমগ্ন। ওই শহরের কুড়িটি ওয়ার্ডে কোথাও হাঁটুজল, তো কোথাও কোমরসমান জল। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি কোচবিহার মিনি বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন কলাবাগান, কদমতলা , হাসপাতাল চৌপটি, বিশ্বসিংহ রোড, সুনীতি রোডের। সমস্ত রাস্তাই জলের তলায় চলে গিয়েছে। হুহু করে বাড়ছে তোর্সা নদীর জল। এত বৃষ্টি এর আগে দেখেননি কোচবিহারবাসী। জল ঢুকতে শুরু করেছে শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাড়িগুলিতে।

    উত্তরের ছয় জেলায় ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকলেও উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় এখনও পর্যন্ত তেমন বৃষ্টি হয়নি। শনিবার রাতে হালকা বৃষ্টি হয়েছে। তবে রবিবার সকাল থেকে অস্বস্তিকর গরম। দুই দিনাজপুরের আকাশ মেঘলা। তবে মাঝিয়ান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া দফতর থেকে জানানো হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দুই দিনাজপুরেই ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

    মালদহের মানিকচক ব্লকের উত্তর চণ্ডীপুর, দক্ষিণ চণ্ডীপুর ও হীরানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেচ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে গঙ্গা এবং ফুলহার টইটম্বুর। এখনও পরিস্থিতি আয়ত্তে। তবে বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে আরও বৃষ্টি হলে সেই প্রভাব মালদহের কিছু জায়গায় পড়তে পারে। উত্তরের নদীগুলির জলস্তর বৃদ্ধি হলে মহানন্দার জলস্তর বৃদ্ধি হবে। সেখানেও বিপদের আঁচ রয়েছে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)