রাতভর বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত দার্জিলিং। মিরিক, সুখিয়াপোখরির অবস্থাও বেহাল। উত্তরবঙ্গের প্রায় সব নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এই আবহে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ডুয়ার্স-সহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির বিভিন্ন এলাকাতেও। শিলিগুড়ির পোড়াঝাড়ে মহানন্দা নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত আস্ত গ্রাম। ফুলেফেঁপে উঠেছে তোর্সা নদী। তার জল ঢুকে জলমগ্ন গোটা কোচবিহার শহর। কোথাও হাঁটুজল জমেছে। কোথাও আবার কোমরজল। উদ্ধারকাজে নেমেছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। মালদহের মানিকচকও জলমগ্ন। সেখানে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কায় প্রশাসনের একাংশ। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারে ভারী বৃষ্টি চলবে। তাই সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে ইতিমধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে এখনও ভারী বৃষ্টি হয়নি। তবে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে প্রশাসন।
দার্জিলিং, কালিম্পঙে সারা রাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে। ধস নেমে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা। সেই সঙ্গে বৃষ্টি হয়েছে ভুটানেও। আর সে কারণে ফুলেফেঁপে উঠেছে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা, জলঢাকা-সহ উত্তরবঙ্গের নদীগুলি। ভুটান এবং পাহাড়ে ভারী বৃষ্টির কারণে জল নেমে এসেছে ডুয়ার্স-সহ উত্তরবঙ্গের সমতলেও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বৃষ্টিতে ভূটানের জলে ভরে গিয়েছে উত্তরবঙ্গ। এই বিপর্যয় দুর্ভাগ্যজনক। দুর্যোগ তো আমাদের কারও হাতে নেই। আমরা মর্মাহত।’’ প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ফুলেফেঁপে উঠেছে মহানন্দা নদী। শনিবার রাতেই নদীর বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে পড়েছে শিলিগুড়ির পোড়াঝাড় এলাকায়। ধসে গিয়েছে বেশ কিছু বাড়ি। বহু মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন মহানন্দা নদীর ব্যারেজের লকগেট খুলে দেন। তার ফলে জল কিছুটা নামতে শুরু করে। তবে প্রশাসনের আধিকারিকদের একাংশ মনে করছেন, জল নামতে অনেক সময় লাগবে। এর মধ্যে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে কয়েক জেলায়। ফলে বৃষ্টি শুরু হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা।
আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস ছিল। সেই মতো শনিবার বিকেল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে কোচবিহারে। রবিবার ভোর থেকে কয়েক ঘণ্টা চলেছে মুষলধারে বৃষ্টি। তার জেরে প্রায় গোটা কোচবিহার জলমগ্ন। শহরের ২০টি ওয়ার্ডে হাঁটু জল, কোথাও কোমর পর্যন্ত জল। সব থেকে খারাপ পরিস্থিতি কোচবিহার মিনি বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, রাজবাড়ি সংলগ্ন এলাকা কলাবাগান, কদমতলা, হাসপাতাল চৌপতি, বিশ্বসিংহ রোড, সুনীতি রোডে। ইতিমধ্যেই হু হু করে বাড়ছে তোর্সা নদীর জল। কোচবিহার সদর মহকুমা শাসক (এসডিও) কুণাল বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, কোচবিহার শহরের দু’টি ব্লকে বিপর্যয় মোকাবিলা দল কাজ করছে। কোচবিহার দু’নম্বর ব্লকের সোনারপুরে তোর্সা নদীর চরে বসতি এলাকা থেকে কিছু মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তোর্সা নদীর জলস্তর এখনও পর্যন্ত বিপদসীমার নীচেই বইছে। কিন্তু তার জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কোচবিহার পুরসভা এলাকার জল বার হতে পারছে না। পুরসভার জল নিকাশি দল, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী তৈরি রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
রাতভর বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা। জলের স্রোতে ধসে গিয়েছে বেশ কিছু কালভার্ট, সেতু। জলমগ্ন বহু এলাকা। সেখানে ভেঙে পড়েছে বহু বাড়ি। উদ্ধারকাজে নেমেছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। তাদের সূত্রে জানা গিয়েছে, ৩৫ জন গ্রামবাসীকে জ়িপ লাইনের মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়েছে। ২০ জনকে নৌকায় চাপিয়ে নিরাপদ স্থান সরানো হয়েছে। এক জনের দেহও উদ্ধার হয়েছে। অন্য দিকে, ভুটানে লাগাতার বৃষ্টির কারণে নদীগুলিতে জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ভুটানের জল হাতিনালা দিয়ে এসে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বানারহাট, বিন্নাগুড়ি এলাকায়। সেখানে বেশ কিছু এলাকা ভেসে গিয়েছে। শিলিগুড়ির দুধিয়ার কাছে ভেঙে পড়েছে লোহার সেতু। জলপাইগুড়ির মাল শহর সংলগ্ন বেশ কিছু এলাকাও জলমগ্ন। ব্যাহত হয়েছে স্বাভাবিক জনজীবন।
উত্তরবঙ্গের ভারী বৃষ্টির ফলে মালদহের মানিকচক ব্লকের উত্তর চণ্ডীপুর, দক্ষিণ চণ্ডীপুর এবং হীরানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রশাসনের একাংশ। যদিও সেচ দফতরের কর্তারা জানান, এই বছর ইতিমধ্যে এই অঞ্চল গঙ্গা ও ফুলহার নদীর জলস্ফীতির ফলে প্লাবিত হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হলে এখানে প্রভাব পড়তে পারে। অন্য দিকে, মহানন্দা নদীর জল আরও বাড়লে সমস্যা তৈরি হতে পারে।
উত্তর এবং দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় এখনও পর্যন্ত সে ভাবে ভারী বৃষ্টিপাত হয়নি। বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দিনাজপুরে ভারী বৃষ্টি হয়েছিল। শুক্রবার সেখানে হালকা বৃষ্টি হয়। শনিবার রাতে কিছুটা বৃষ্টি হলেও রবিবার সকাল থেকে তেমন বৃষ্টি হয়নি। তবে আকাশ মেঘলা।
শনিবার সন্ধ্যা থেকে টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছে দার্জিলিং, কালিম্পঙে। তাতেই বিধ্বস্ত পাহাড়। বহু জায়গায় ধস নেমে রাস্তা বন্ধ। তিস্তার জল উঠে এসেছে জাতীয় সড়কের উপর। এখনও পর্যন্ত মোট ১৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে দার্জিলিং থেকে। পাহাড়ের জল এ বার নামছে সমতলেও। আর তাতেই বিপর্যস্ত হচ্ছে উত্তরবঙ্গের সমতল এলাকা।