সোহম কর, কলকাতা; হাতের তালুতে ধরে এক ঘা। ফটাস করে ফাটল আস্ত নারকেলখানা। আধখানা করে নিয়ে মা-দিদিমারা কাজে লেগে পড়লেন। তারপর কুরনিতে নারকেল কোরার কর্কশ কিন্তু মন ভালো করে দেওয়া শব্দ। শুরু নাড়ু তৈরি। এমন ছবি প্রায় ফিকে হতে বসেছে। কারণ এখন দু’পা হেঁটে পাড়ার দোকানে গেলেই ১০ টাকার প্যাকেটে পাঁচটা নাড়ু। সেই নাড়ু নিয়ে সদ্য বাবা হওয়া এক তরুণ আর সদ্য দাদু হওয়া প্রৌঢ়ের মধ্যে ব্যাপক তর্কাতর্কি- ‘নাড়ু দুনিয়ায় কে এগিয়ে?’ ‘বাড়িতে তৈরি?’ ‘না প্যাকেটে থাকা নাড়ু?’ বিবাদ বিতর্ক চলতে চলতেই ঠাকুরের সামনে ছোট-বড় সকলেই হাত পেতে দাঁড়াবেন। নারকেলের নাড়ুই ছোটবেলায় শিখিয়ে দিয়েছে লাইন করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। সকলের হাতেই পড়বে সমান পরিমাণ নাড়ু। তাতেই সন্তুষ্ট হতে হয়। এ পাঠই আজীবন শিখেছে বাঙালি। তাই চিরাচরিত নারকেল নাড়ু স্রেফ একটা মিষ্টান্ন নয়, তা বঙ্গ অনুশাসনের অঙ্গও বটে।
নারকেল কোড়ার পর গুড় অথবা চিনি। আগুনে পাত্র বসিয়ে জম্পেশ করে পাক। তারপর হাতে ঘি মাখিয়ে গোল গোল করে তৈরি নাড়ু। কারও পছন্দ সাদা অর্থাত্ চিনির। কেউ বলেন, ‘গুড় ছাড়া কি নাড়ু হয়?’ তবে নাড়ুকে শুধু নারকেলে বাধলে বাঙালির চলে না। মুড়ি, খই, তিলও রয়েছে তালিকায়। তবে এগিয়ে নারকেলই। ফলে চিরকালই এ উৎসব মরশুমে নারকেলের দাম থাকে চড়ার দিকে।
সোমবার লক্ষ্মীপুজো। শনিবার সকাল থেকেই কলকাতায় ঢেলে বসেছে সবজি, ফল, মূর্তির বাজার। জায়গা বিশেষে নারকেলের দাম, ৫০ থেকে ৮০। যাদবপুরে এক ক্রেতা বললেন, ‘৭০ টাকা দিয়ে নারকোল কিনে তা দিয়ে নাড়ু কে বানাবে? তার চেয়ে কিনে নেওয়াই ভালো। তবে এটাও ঠিক, বাড়িতে তৈরি নাড়ুর স্বাদ তো আর মিলবে না।’ অর্থাৎ যাঁদের বাড়িতে দিদিমা-ঠাকুমারা নাড়ু তৈরি করছেন তাঁরা লক্ষ্মীপুজোয় ঘুরছেন কলার একটু তুলে। গড়িয়া বাজারে এক ক্রেতা সাদা নারকেল নাড়ু খুঁজছেন। ‘সাদা নাড়ুটা খেতে সবচেয়ে ভালো। বেশ নরম। কিন্তু পাচ্ছি না।’ বলে পাশের দোকানে খুঁজতে গেলেন। টালিগঞ্জে একজন মঠ, কদমা, খই কিনে চলে যাচ্ছিলেন। বিক্রেতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘নাড়ু লাগবে না?’ তিনি প্রায় বুক ফুলিয়ে বললেন, ‘নারকেল কিনেছি। বাড়িতে নাড়ু হবে। এসব ঠান্ডা কেউ খায়? গরম গরম খেতে হয়। আজকালকার কেউ এসব জানেই না।’
তবে এসব শুনলে দোকানদারদের আবার গোঁসা হয়। প্যাকেটের নাড়ুর প্রতি এই বিদ্বেষ একেবারেই পছন্দ নয়। এক ব্যবসায়ী বললেন, ‘এই নাড়ু কি মেশিনে তৈরি হচ্ছে? এগুলো সবই তো কারও না কারও হাতে তৈরি।’ অন্য পাশ থেকে অন্য এক দোকানদার ফুট কাটলেন, ‘আমাদেরও দু’পয়সা রোজগার হচ্ছে, এ সহ্য হচ্ছে না, না?’
রোজগার, প্রতিযোগিতা, খেতে ভালো, খেতে মন্দ, গরম-ঠান্ডা এসব তর্ক চলতেই থাকবে। তবে নারকেল নাড়ু বিরাজমান স্বমহিমায়। এ জিনিস খাইয়ে তৃপ্তি। খেয়ে আরও তৃপ্তি।