ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থাকে কার্যত শাসকদলের অস্ত্র হিসেবে পরিণত করেছে নির্বাচন কমিশন ...
আজকাল | ০৬ অক্টোবর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের নির্বাচন কমিশনের (ইসিআই) সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড এবং প্রতিক্রিয়াগুলি তার কার্যপ্রণালির গভীর সংকটকে সামনে এনেছে। নানা পদক্ষেপ ও অবহেলার মাধ্যমে ইসিআই এখন এমন এক কেন্দ্রীভূত, স্বেচ্ছাচারী এবং গোপন প্রশাসনিক কাঠামোয় পরিণত হয়েছে, যা জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান করে না এবং সংবিধান প্রদত্ত কর্তব্য—নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করা—সে দায়িত্ব পালনে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী সম্প্রতি অভিযোগ করেন যে বেঙ্গালুরুর মহাদেবপুরা বিধানসভা কেন্দ্রে প্রায় ছয় লক্ষ ভোটারের মধ্যে এক লক্ষ দুইশো পঞ্চাশটি ভোট ভুয়ো এবং এর ফলেই বিজেপি অল্প ব্যবধানে আসনটি জয় করেছে। এই অভিযোগের জবাবে নির্বাচন কমিশনের আচরণ ছিল আক্রমণাত্মক ও আত্মরক্ষামূলক। কমিশন তথ্য যাচাইয়ের নামে কোনও প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করেনি, বরং আইনি জটিলতা তৈরি করে এবং শপথনামা দাবি করে বিরোধী নেতাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে। একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে আলন্দ বিধানসভা কেন্দ্রের ভোট জালিয়াতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরও।
গত কয়েক বছরে ইসিআই ভারতের ভোটদান প্রক্রিয়াকে কার্যত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরও বিভিন্ন স্থানে সন্দেহজনকভাবে ভোট যুক্ত হওয়ার ঘটনায় কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে। সাম্প্রতিক সময়ে ভোটার তালিকায় ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে, এবং তদন্তে সহযোগিতা করতে কমিশনের অস্বীকৃতি এই সন্দেহ আরও গভীর করেছে। সমালোচকরা বলছেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২৪ অনুযায়ী কমিশনের অবারিত ক্ষমতা এবং ২০২৩ সালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার আইন অনুসারে কমিশনারদের যে প্রায় সম্পূর্ণ দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেটিই তাদের এমন স্বেচ্ছাচারী আচরণের পথ প্রশস্ত করেছে।
১৯৮৪ সালে এ.সি. জোস বনাম শিবন পিল্লাই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট আগেই এই সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিল। আদালত তখনই সতর্ক করেছিল যে, যদি নির্বাচন কমিশনকে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং যদি কমিশন কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অনুগত হয়, তবে তা গণতন্ত্রের শিকড়ে আঘাত হানতে পারে। আদালত বলেছিল, “যদি কমিশনের হাতে সীমাহীন ও খামখেয়ালি ক্ষমতা দেওয়া হয়, এবং কমিশনের সদস্যরা যদি কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাহলে তারা এমন নির্দেশ দিতে পারে যা রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার সততা নষ্ট করবে।” আজকের পরিস্থিতি যেন সেই সতর্কবার্তাকে বাস্তবে পরিণত করেছে।
বিহারে সম্প্রতি বিশেষ নিবিড় পুনর্বিবেচনা (SIR) কর্মসূচি হঠাৎ ঘোষণা করে এবং পরে তা দেশজুড়ে বাড়িয়ে কমিশন যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে আরও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ, একপাক্ষিক নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং কার্যত জবাবদিহিতাহীন অবস্থার কারণে ইসিআই এখন এক ‘সম্পূর্ণ ক্ষমতাবান’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে তার ভেতর গর্ব, ঔদ্ধত্য ও অবমাননাকর মনোভাব প্রবলভাবে বেড়ে উঠেছে।
২০১৮ সালের পর থেকে দিল্লির নির্বাচন সদন কার্যত একটি গোপন দুর্গে পরিণত হয়েছে। জনগণ, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলির কাছ থেকে আসা প্রস্তাব বা প্রশ্ন কমিশন আমলেই নিচ্ছে না। এমনকি তথ্য জানার অধিকার আইন (আরটিআই) অনুসারে করা প্রশ্নগুলিরও কোনও উত্তর দেয় না, আর দিলেও তা অসম্পূর্ণ বা বিভ্রান্তিকর হয়। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, কমিশন নিজের পরিচালনায় ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন পরিচালনাকারী রিটার্নিং অফিসারদের সম্পর্কেও কোনও তথ্য নেই বলে জানিয়েছে।
দেশের নির্বাচনী কাঠামো এখন এতই বিশাল ও জটিল যে তা নিয়ন্ত্রণ করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। ১৯৫২ সালে ভারতের ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ১৭.৩ কোটি, যা ২০২৪ সালে বেড়ে ৯৬.৮ কোটিতে পৌঁছেছে। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ২.২৫ লক্ষ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.৫ লক্ষ, যেখানে দেড় কোটিরও বেশি কর্মী এবং দুই হাজারের বেশি পর্যবেক্ষক কাজ করেন। ফলে কমিশনকে সাত দফায় লোকসভা নির্বাচন করতে হয়, যা নির্বাচনের পবিত্রতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। তাই এই পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা ভারতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। প্রয়োজন হচ্ছে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ, যাতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১–এ বর্ণিত “রাজ্যসমূহের সংঘ” ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এক সত্যিকারের ফেডারেল কাঠামো গড়ে ওঠে।
মূল সংবিধানের খসড়া অনুযায়ী, অনুচ্ছেদ ২৮৯–এ কেন্দ্র ও রাজ্যের জন্য পৃথক নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল যে সংসদ ও রাষ্ট্রপতি-সহ কেন্দ্রের নির্বাচনের দায়িত্ব থাকবে রাষ্ট্রপতির নিযুক্ত কমিশনের হাতে, আর রাজ্যের নির্বাচনের দায়িত্ব থাকবে রাজ্যপালের নিযুক্ত কমিশনের হাতে। কিন্তু পরে ড. বি.আর. আম্বেদকর এটি পরিবর্তন করে অনুচ্ছেদ ৩২৪–এর অধীনে একটি কেন্দ্রীয় কমিশনের ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেছিলেন, এটি “একটি মৌলিক পরিবর্তন” যা নির্বাচন ব্যবস্থাকে একক নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
আজকের প্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিবর্তনই ভারতের গণতন্ত্রের ওপর ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ১৯৯২ সালের ৭৩তম ও ৭৪তম সংশোধনের পর প্রতিটি রাজ্যে স্থানীয় স্বশাসন ব্যবস্থার জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশন (এসইসি) গঠিত হয়েছে, যারা পঞ্চায়েত ও পৌরসভা নির্বাচনের দায়িত্ব সামলায়। এই কমিশনগুলি সংবিধানসম্মত, স্বশাসিত এবং প্রায় ইসিআই–এর সমতুল্য ক্ষমতা ভোগ করে।
কমিশনের কাঠামো ও কার্যপ্রণালী এখন এতটাই উন্নত যে তারা চাইলে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনও পরিচালনা করতে সক্ষম। তাই যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া রাজ্যভিত্তিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, তবে ভারতের গণতন্ত্রকে ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রে’ পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে—যে বিপজ্জনক পথে দেশ আজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।