• এল নিনোর কারণেই কি উত্তরবঙ্গে বিপর্যয়?
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ০৬ অক্টোবর ২০২৫
  • সুমিত চৌধুরী

    প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে তৈরি হওয়া উষ্ণ বায়ুমণ্ডলের প্রভাবে প্রকট এল নিনোই কি শেষ পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের এই বিপর্যয় ডেকে আনলো? কোন সন্দেহ নেই অন্যান্য কারণ বাদ দিলেও শনিবার গভীর রাত থেকে রবিবার দুপুরের মধ্যে কয়েক ঘণ্টায় প্রায় মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টির কারণেই আচমকা বন্যা নেমেছে পাহাড়ের নদীতে তিস্তা সংকোশ বালাসন ফুঁসে উঠেছে। আন্তর্জাতিক আবহাওয়াবিদরা ওয়েদার ক্যালেন্ডার তৈরি করার সময়েই আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিলেন এ বছর ভারতবর্ষে এল নিনোর প্রভাবে অতিবৃষ্টি এবং চরম আবহাওয়া পরিস্থিতি দেখা দেবে। অতিবৃষ্টি এবার তুমুল ভাবে হয়েছে। গোটা ভারতবর্ষে এখনো অবধি এ বছর মোট ৫৮টি বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। গঙ্গার উপর বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে ২২টি। এল নিনোর প্রভাবে এরকমটা হচ্ছে বলে আবহাওয়াবিদদের দাবি।

    এল নিনো অবশ্য কখন তৈরি হবে তার কোন নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার নেই। পরিবেশ বিদদের হিসাব অনুযায়ী সাধারণত দু’বছর থেকে আট বছরের ব্যবধানে এল নিনো তৈরি হতে পারে। বিশ্বজোড়া আবহাওয়াচক্রের যে দুনিয়াদারি তার মধ্যে এল নিন একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

    পাহাড়ে যে বিপুল পরিমাণে ধ্বস এবং বন্যা পরিস্থিতি আচমকা তৈরি হয়েছে তা বহুলাংশে সে অভূতপূর্ব। রবিবার বিকেল পর্যন্ত সংবাদ সংস্থার খবর অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ২০। একাধিক জায়গায় সেতু ভেঙেছে। দার্জিলিং কালিম্পং মিরিক প্রবল ভাবে ধ্বসের কবলে। পাহাড়ের নদী যত ডাউন স্ট্রিমে যত এগিয়েছে তত জল ফুলে ফেঁপে উঠেছে। একাধিক জাতীয় অভয়ারণ্য থেকে বন্যপ্রাণ ভেসে যাওয়ার খবর এসেছে। কোথাও কোথাও এক আধ পর্যটকও আপাতভাবে নিখোঁজ রয়েছেন এরকম অসমর্থিত খবর আসছে। বাকি পর্যটক টা সকলেই প্রায় হোটেল বন্দী। তুলনামূলকভাবে সমতলে মূর্তি নদীর ধারের রিসোর্টে ও বহু জায়গায় জল ঢুকেছে।

    তবে পরিবেশবিদ এবং বিশেষ করে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের একটা বড় অংশের মতে শুধুমাত্র এল নিনোর উপরে পাহাড়ের এই বিপর্যয়ের দায় চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ একাধিক জায়গায় এমন সমস্ত বাজারে লাগাতে ধ্বস নেমেছে যেগুলো পাহাড়ে অতীতে ধ্বস নামতে দেখা যায়নি। তাদের মতে নতুন নতুন এলাকায় ধ্বস নামবার কারণ যথেচ্ছ উন্নয়ন বা অপ উন্নয়ন। বিপুল পরিমাণে বনাঞ্চল ধ্বংস করা অপরিকল্পিতভাবে হোটেল নির্মাণ যথেচ্ছ ভাবে পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোর চেষ্টা, সব কিছু মিলিয়ে গোটা পাহাড়কে ধ্বস প্রবন পাহাড়ে পরিণত করেছে। এমনিতেই হিমালয় ভৌগোলিক বিচারে এখনো তৈরি হচ্ছে। এটা এখনো নবীন ভঙ্গুর পর্বত মালার মধ্যে পড়ে।

    স্বাভাবিকভাবে উন্নয়নের নামে এই যথেষ্ট নির্মাণ বিপর্যয় ডেকে আনার অন্যতম কারণ। বিশেষ করে যেভাবে পাহাড়ের পাহাড়ের ঢালে, আর সি সি গাঁথুনি তোলা হচ্ছে তা পাহাড়ে নিজস্ব ইকো সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।

    এছাড়াও পরিবেশবিদদের আরো অভিমত ঠিক দু বছর আগে২০২৩ সালের চৌঠা অক্টোবর সিকিমের চুংথাং এর যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বিপুল ধস এবং আচমকা নেমে আসা জলরাশি ধাক্কায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল, তার বিপুল পলি এবং বর্জ্য রঙ্গিত হয়ে তিস্তার গর্ভে এসে জমা হয়েছিল। বাঁধ বন্দী তিস্তার আর ক্ষমতা ছিল না স্রোতের টানে তাকে আরো নীচের দিকে টেনে নামিয়ে দেয়। হলে বিপুল পরিমাণ কংক্রিটের জঞ্জাল রাবিশ এবং পলি তিস্তার গর্ভে জমা হয়েছে। গত দু বছরে তার কোন ডিসিল্টিং হয়নি। স্বাভাবিকভাবে হঠাৎ বেশি বৃষ্টিতে যখন জল নেমে আসছে তখন তিস্তার পক্ষে সেই জল আর ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং একা এল নিনোকে খলনায়ক বানালে সম্পূর্ণ বাস্তবতা কে চিহ্নিত করা হবে না।

    এদিকে ভুটানে গ্রুপ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের লক গেট খারাপ হয়ে যাওয়ায়, জল বিপদ সীমার ওপরে উঠে গেল লকগেট খোলা সম্ভব হয়নি। ফলে লক গেট ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদি সত্যিই এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে সেটা পশ্চিমবঙ্গের জন্য নতুন বিপদ ডেকে আনবে।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)