শীর্ষ রাজ্য প্রশাসনের সাহায্যে নিশ্চিত মৃত্যুর সড়ক পেরিয়ে এলাম, মিলল দুর্লভ পুনর্জন্ম
বর্তমান | ০৭ অক্টোবর ২০২৫
বিশ্বজিৎ দাস, শিলিগুড়ি: ন-দিনের সফরে আমাদের গন্তব্য ছিল সুকনা, কালিম্পং, জোরপোখরি ও মিরিক। ৩০ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু। ১ অক্টোবর পাহাড়ে ওঠা থেকেই লাগাতার কুয়াশা, মেঘ, বৃষ্টি। এক্ষেত্রে পাহাড়ে গাড়ি চালানো বিপজ্জনক। তবু ঝুঁকি নিয়েই ড্রাইভ করে ৩ অক্টোবর চলে এসেছিলাম প্রায় সাড়ে ৭ হাজার ফুট উচ্চতার নেপাল সীমানা লাগোয়া জোরপোখরিতে। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়ার কথা থাকলেও, ‘পাহাড়ের রানি’র দেখা মেলেনি সারাদিন। পরদিন, ৪ অক্টোবর বিকেল থেকে শুরু হল বৃষ্টি। রাত বাড়তেই বৃষ্টির গতি যেন লাগাম ছাড়িয়ে গেল। পাহাড়ে এত সজোর বৃষ্টিপাতের শব্দ পাহাড়ে আগে কখনও শুনিনি। স্ত্রী এবং দুই নাবালিকা কন্যা রীতিমতো আতঙ্কিত। রাত ১২টা নাগাদ একনাগাড়ে বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হল লাগাতার বজ্রপাত, গভীর রাত পর্যন্ত। একেক সময় আলোর ঝলকানি এতটাই কাছে এবং তীব্র ছিল, মনে হচ্ছিল এই বুঝি বাংলোতেই বাজ পড়ল। লোডশেডিংয়ের অন্ধকার চিরে বৃষ্টি আর বাজের আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছিল, যেন লক্ষ লক্ষ বছর আগের সৃষ্টির সময় ফিরে গিয়েছি। আতঙ্কের সঙ্গেই চিন্তা বাড়ছিল, পরবর্তী গন্তব্য মিরিক যাব কী করে? বা আদৌ শিলিগুড়ি পর্যন্ত নামতে পারব তো?
পরদিন সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার আনন্দ মিলিয়ে গেল দুঃসংবাদে। মিলল। বাংলোর এক কর্মী খবর দিলেন, পরপর গাছ পড়ে জোরপোখরি থেকে মিরিক যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। আবার মিরিক থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার দুধিয়া ব্রিজ ভেঙে ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটেছে। খবর এল একাধিক মৃত্যুরও। কর্মীরা অভয় দিচ্ছিলেন, চিন্তা নেই, গাছ সরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু মন মানেনি।
দার্জিলিং প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ হলে, তিনি জানালেন, ধসে বিপর্যস্ত গোটা পাহাড়। মিরিক থেকে দার্জিলিং যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। রোহিনী রোড বন্ধ। খোলা বলতে একমাত্র পাংখাবাড়ি রোড। এর তীব্র বাঁক, চড়াই-উতরাই অত্যন্ত বিপজ্জনক হলেও, আমাদের কাজে আর কোনও রাস্তা নেই এই পথ ছাড়া। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ আমরা জোরপোখরি ভায়া ঘুম ভায়া কার্শিয়াং ভায়া পাঙ্খাবাড়ি ভায়া শিলিগুড়ির রুট ধরলাম। হোয়াটসঅ্যাপে আসতে থাকা একের পর এক বেদনাদায়ক খবর চিন্তা বাড়াচ্ছিল আরও। সিদ্ধান্ত নিলাম, সাবধানে দ্রুত সমতলে নামতে হবে।
প্রথম ধাপ জোরপোখরি থেকে ঘুম। প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথ যেতে চোখে পড়ল প্রতি এক-দেড় কিলোমিটার অন্তর ধসের চিহ্ন। রাস্তা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে গাছ পড়ে। ঘুম পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই শুরু হল লম্বা যানজট। ঘুম থেকে সোনাদার অল্প রাস্তা পেরলাম এক ঘণ্টায়। পরের গন্তব্য কার্শিয়াং। কার্শিয়াং ট্যুরিস্ট লজের পাশ থেকে শুরু হয়েছে অতি বিপজ্জনক পাঙ্খাবাড়ি রোড। এখানে পাশাপাশি দুটি গাড়ি যাওয়াও এখানে রীতিমতো চিন্তার। বাঁদিকে কোন রেলিং নেই অধিকাংশ জায়গায়। বিকেল ৪টের পর থেকে শুরু হল অতিঘন কুয়াশা। এরই মধ্যে আবার জায়গায় জায়গায় গাড়ি খারাপ হওয়ায় পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন। যেভাবে গাড়িগুলিকে পাশ দিয়ে এগোতে হচ্ছিল, ভাবছিলাম, এ বুঝি মৃত্যুর পথ!
কার্শিয়াং থেকে আড়াই কিলোমিটার নীচে সামনের দুটি গাড়ি খারাপ হওয়ায় বিপদ আরও বাড়ল। বুঝলাম, যদি এইভাবে চলতে থাকে, সারারাত অতি বিপজ্জনকভাবে কাটাতে হবে। কারণ, দেখতে পাচ্ছি, পাহাড় থেকে বিরাট রাস্তায় এসে পড়েছে। কোথাও আবার রাস্তার তিনভাগের একভাগ অংশ ধসে অতলে গড়িয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চষ্টা করি। সুফলও পাই। কিছুক্ষণের মধ্যে যানজট মুক্ত হতে শুরু করে রাস্তা। ততক্ষণের সন্ধ্যা নেমেছে। সাড়ে ৮ ঘণ্টা পর যখন শিলিগুড়িতে পৌঁছালাম, মনে হল, আরও একবার জীবন ফিরে পেলাম!