সুখেন্দু পাল, বর্ধমান: জল ছেড়েই যাচ্ছে ডিভিসি। সেই জলে পুষ্ট দামোদর এখন পাগলপারা! তার খরস্রোত রোখার সাধ্যি কার! সামনে পড়লে গিলে খাচ্ছে সব কিছুই। রায়নার জাকতা গ্রামের একটি ঘাটে স্নান সারছিলেন বৃদ্ধা মাতুরি টুডু। কোনও কারণে পা পিছলে পড়ে যান স্রোতের মুখে। মুহূর্তেই ভেসে যান তিনি। আর ভেসে যাওয়া মানে পাড়ে জীবিত ফিরে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। দামোদরের গ্রাসে মরণ নিশ্চিত। কিন্তু, সবাইকে অবাক করে মাতুরি আজ ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’।
মাতুরির বয়স এখন পঁয়ষট্টির কোঠায়। নদীর পাড়ে বাস। শৈশব থেকেই দামোদরের সঙ্গে তাঁর প্রেম-ভালোবাস। সাঁতার কেটে এপার, ওপার হওয়া ছিল তাঁর শখ। ছেলেবেলার সেই অভ্যাসের জোরেই প্রাণে বাঁচলেন তিনি। গ্রামের ঘাটে তলিয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ মাতুরি হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। পরে নিজেকে সামলে স্রোতের সঙ্গে যুঝতে শুরু করেন। কখনও চিৎ হয়ে, কখনও উপুড় হয়ে সাঁতার কাটতে থাকেন। এভাবে কখন যে তিনি ২০ কিলোমিটার চলে গিয়েছেন, তা টেরই পাননি মাতুরি। এসে পৌঁছন জামালপুরের মুইদিপুরে। ভালোবাসার খাতিরেই হোক কিংবা সাহসিকতাকে সম্মান জানিয়ে হোক—দামোদর মাতুরির হাতে ধরিয়ে দেয় গাছের একটি শুকনো ডাল। সেটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে চিৎকার করতে থাকেন তিনি। গ্রামবাসীরা বৃদ্ধার আওয়াজ পেয়ে তাঁকে উদ্ধার করেন।
দীর্ঘক্ষণ জলে থাকার পর ডাঙায় উঠে সাময়িক অসুস্থ হয়ে পড়েন মাতুরি। জামালপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসার পর আবার তিনি স্বমহিমায়। দামোদর তাঁকে জীবিত ফিরিয়ে দিয়েছে শুনে হাসপাতালে ভিড় উপচে পড়ে। সবার সামনেই তিনি বলেন ওঠেন, ‘ধুৎ! এটা কোনও বিষয়ই নয়। সাঁতার জানলে আবার ভয় কিসের?’ বৃদ্ধার এহেন অফরন্তু প্রাণশক্তি দেখে উচ্ছ্বসিত এলাকার বাসিন্দা ও পুলিশ কর্মীরা। মাতুরি তখন বলে চলেছেন, ‘দিব্যি স্নান করছিলাম। দামোদরের এই ভয়ঙ্কর রূপ আমার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু, কিভাবে যে পা পিছলে গেল, বুঝে উঠতে পারলাম না। স্রোতে তোড়ে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিই। সাঁতার কাটতে শুরু করি। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। নদীর পাড়ে কেউ কোথাও নেই। এক সময় মনে হয়েছিল মৃত্যু নিশ্চিত। তবে সহজে হার মানব না। নিঃশ্বাসের শেষ টান পর্যন্ত লড়ে যাব। সাঁতার কাটতে কাটতে মাঝ নদে এসে পড়ি। তারপর ধীরে ধীরে কিনারার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি। হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। আর ঠিক তখনই আমার নজরে আসে একটি গাছের ডাল ভেসে যাচ্ছে। সেটা ধরেই চিৎকার করতে থাকি। গ্রামবাসীরা ছুটে আসেন। তাঁরা তখন আমার কাছে স্বয়ং ভগবান। কেউ না এলে হয়তো বাঁচতাম না। কারণ, ততক্ষণে রাত নেমে এসেছিল।’
গ্রামবাসীদের কাছে খবর পেয়ে জামালপুর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছয়। এক পুলিশ আধিকারিক বলছিলেন, ‘ওঁর লড়াইকে কুর্নিশ। এই বয়সে দামাল দামোদরে এতটা পথ সাঁতার কাটা সহজ কথা নয়। ওঁর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো হার্টফেল করে যেতেন। বৃদ্ধা লড়াই করে গিয়েছেন। এটাই আসল বাঁচার লড়াই।’
হার না মানা বৃদ্ধার সংযোজন, ‘জীবন-যুদ্ধে সাহসই মূল অস্ত্র’। স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন কি আত্মস্থ করেছেন মাতুরি টুডু? সাহসীদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়।-নিজস্ব চিত্র