আইএসআই পরিচালনায় নয়া খসড়া বিলে কি স্বশাসন খর্বের শঙ্কা?
আনন্দবাজার | ০৭ অক্টোবর ২০২৫
জওহরলাল নেহরুর আমলের আইন বাতিল করে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের (আইএসআই) খোলনলচে পাল্টাতে উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্র। বঙ্গ রেনেসাঁসের স্মারক ঐতিহ্যবাহী আইএসআইয়ের দেশ জুড়ে বিভিন্ন কেন্দ্র থাকলেও সদর দফতর আজও কলকাতায়। নয়া সরকারি পরিকল্পনায় সেখানে আইআইটি, আইআইএম ধাঁচের পরিচালন ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা চলছে। তবে, এর ফলে জাতীয় স্বার্থের গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীন, স্বশাসিত সত্তা এবং কলকাতা কেন্দ্রিকতা— দুই-ই খর্ব হতে পারে বলে আশঙ্কা।
কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা রূপায়ণ মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে আইএসআই সংক্রান্ত খসড়া বিল প্রকাশিত হয়েছে দেবীপক্ষের শুরুতেই। ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত এ বিষয়ে নানা জনের মত চাওয়া হয়েছে। আইএসআই এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নানা প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের শরিক বিশিষ্টজনেদের অনেকের অভিমত, নতুন ব্যবস্থায় আইএসআই পরিচালনার গণতন্ত্র ক্ষুণ্ণ করে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম হবে। জনৈক বিশিষ্ট বলেন, “সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা আইআইটিগুলিরও ভাল-মন্দ নানা দিক আছে। খসড়া বিলে কলকাতায় আইএসআইয়ের সদর দফতর নিয়েও স্পষ্ট কিছু বলা নেই।’’
১৯৫৯ সালের আইএসআই আইনে প্রতিষ্ঠানটিকে ‘ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইম্পর্ট্যান্স’ আখ্যা দিয়ে এর স্বশাসিত সত্তাটি সুরক্ষিত করে নেহরু সরকার। সেই আইনবলে আইএসআই কাউন্সিলে সরকার মনোনীত প্রতিনিধি এবং ভোটে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, আধিকারিকদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। নতুন খসড়া বিলে আইএসআই প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা কাউন্সিল বাতিল করে বডি অব গভর্ন্যান্স বা প্রশাসকমণ্ডলী গড়া হবে। আইআইটি, আইআইএমের ধাঁচে রাষ্ট্রপতি হবেন আইএসআইয়ের ভিজ়িটর। সরকারি সুপারিশে তিনি প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারপার্সন ঠিক করবেন। প্রশাসকমণ্ডলীতে তিন জন শীর্ষ স্তরের সরকারি আমলা, চার জন সরকার মনোনীত বিশিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া আইএসআইয়ের ডিরেক্টর, ডিন প্রমুখেরা থাকবেন। ডিরেক্টরকেও কার্যত সরকার বাছাই করবে। আইএসআই কাউন্সিলে অভ্যন্তরীণ প্রতিনিধি বাছাইয়ে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মীদের ভোটাধিকার আর থাকবে না।
১৯৫৯-এর আইন অনুযায়ী, দু’বছর অন্তর পাল্টানো কাউন্সিলে এক জন প্রেসিডেন্ট এবং চেয়ারম্যান থাকেন। তাঁরা স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বিশিষ্ট ব্যক্তি, আইএসআইয়ের কর্মী নন। একটি নির্দিষ্ট কমিটির সুপারিশে কাউন্সিলই পাঁচ বছর অন্তর আইএসআইয়ের ডিরেক্টর বাছাই করে। সংশ্লিষ্ট কমিটিতে কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছাড়া দু’জন বহিরাগত বিশেষজ্ঞও থাকেন। সাধারণত দেশের কোনও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, গবেষককে কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে আইএসআইয়ের প্রেসিডেন্ট করে। অথবা আইএসআই সোসাইটির জেনারেল বডির সদস্যেরা ভোটাভুটি করেন।
আইএসআই সোসাইটির সদস্য বাড়িয়ে খানিকটা ময়দানের ক্লাবের আদলে ইদানীং ভোটাভুটি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কেন্দ্রের প্রাক্তন মুখ্য বিজ্ঞান উপদেষ্টা কে বিজয়রাঘবন প্রেসিডেন্ট পদের ভোটে গত বছর অধ্যাপক শঙ্করকুমার পালের কাছে হেরে যান। তাতেই কেন্দ্রীয় সরকার ঘনিষ্ঠেরা ক্ষুব্ধ হন বলে দাবি। বলা হচ্ছে, এটাই খোলনলচে পাল্টানোর আসল কারণ। তাতে অধ্যাপকদের একাংশকে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি, ভোটাভুটি থেকে দূরে রাখা যাবে বলেও কারও কারও মত।
তবু পুরনো ব্যবস্থায় আইএসআইয়ের অভ্যন্তরীণ শিবির বা সরকার ঘনিষ্ঠ কারও পক্ষেই ছড়ি ঘোরানো সম্ভব নয় বলে কোনও কোনও অধ্যাপকের মত। তাঁদের দাবি, শঙ্করকুমার পাল প্রেসিডেন্ট হলেও কেন্দ্রের কড়া সমালোচক বিশিষ্ট গণিতবিদ এম এস রঘুনাথনকে কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করতে পারেননি। কাউন্সিলে কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা তাতে আপত্তি করেন। প্রাক্তন ইসরো-কর্তা কে রাধাকৃষ্ণান চেয়ারম্যান হন।
আইএসআইয়ের খোলনলচে পাল্টালে এই ভারসাম্য থাকবে না বলে সংশ্লিষ্টদের একাংশের আশঙ্কা। নিয়োগ থেকে শুরু করে পাঠ্যক্রম তৈরিতে কেন্দ্রের একচ্ছত্র প্রভাব পড়বে। খসড়া বিলে নয়া ব্যবস্থায় শিল্প ক্ষেত্রের সঙ্গে গাঁটছড়া, রাজস্ব আদায়ে সুবিধার কথা বলা হচ্ছে। তাতে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণাধর্মী অধ্যয়ন ধাক্কা খাবে বলে অন্য একটি মহল মনে করছে।
আইএসআইয়ের সাবেক পাঠক্রমের শিক্ষার্থীরা এখনও নিখরচায় পড়াশোনা করেন। তাঁদের উপরেও কোপ পড়ার আশঙ্কা থাকছে। গত এক দশকে দু’দফায় আইএসআইয়ের ডিরেক্টর সংঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়াদ সম্প্রতি তিন মাসের জন্য বাড়ানো হয়েছে। নয়া ডিরেক্টর বাছাইয়ের সময়েই নতুন বিলের খসড়া প্রকাশ নিয়ে নানা মহলে চর্চা চলছে।