বেড়িয়ে ফেরার আনন্দ-উচ্ছ্বাস নেই। বদলে থমথমে বালকের মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। খাটে বসিয়ে বাবা-মা বছর দশেকের ছেলেটিকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করলেও তাতে বিশেষ কাজ হচ্ছে বলেমনে হল না। টিভিতে চলা পাহাড়ের বিপর্যয়ের খবর দেখলেই চোখনামিয়ে নিচ্ছে সে। পাহাড় নিয়ে কিছু জানতে চাইলে অস্পষ্ট ভাবে শুধু বলে উঠছে, ‘‘আর কোনও দিন পাহাড় যাব না!’’
উত্তরবঙ্গের বিপর্যয় পেরিয়ে সোমবার সকালেই ছেলে বিনায়ক এবং স্ত্রী স্নেহা দে নন্দীকে নিয়ে গড়িয়ার বাড়িতে ফিরেছেনজয়দীপ দে। যদিও ফেরার কয়েক ঘণ্টা পরেও ছেলের মন থেকেএখনও আতঙ্ক কাটাতে পারেননি ওই দম্পতি। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেও চাপা আতঙ্ক থেকে মুক্ত হননি তাঁরাও।
গত রবিবার এনজেপি স্টেশন থেকে বন্দে ভারত ধরেকলকাতায় ফেরার কথা থাকলেও বিপর্যয়ের সময়ে স্টেশনে সময়ে পৌঁছতে পারেনি পরিবারটি। দার্জিলিং থেকে ঘণ্টা তিনেকের পথ পেরোতে ১১ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। জয়দীপ বলেন, ‘‘রাতের বিপর্যয়ের কথা ভেবেই সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে আসি। গাড়ি নিয়ে দশ মিনিট এগোতেই দেখি, ধসেরাস্তার অর্ধেকটাই নদীতে চলে গিয়েছে। এর পরে যে পথ দিয়েই নীচে নামার চেষ্টা করেছি, সর্বত্র শুধু ধ্বংসের ছবি।’’ শেষে কোনও মতে রাত ৮টা নাগাদ এনজেপি-তে এসে পৌঁছন তাঁরা। এর পরে প্রশাসনের উদ্যোগে বাসে সোমবার সকালে কলকাতায় ফেরেন।
জানা গেল, অষ্টমীর দিন গড়িয়ার বাড়ি থেকে ট্রেনে উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলেন পেশায় ব্যবসায়ী জয়দীপ। চটকপুর, মিরিক ঘুরে দার্জিলিং পৌঁছন। শনিবার রাতের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জয়দীপের স্ত্রী স্নেহা বললেন, ‘‘এমন বৃষ্টি, পাঁচ ফুট দূরের কাউকেও দেখা যাচ্ছিল না। সেই সঙ্গে মেঘের তীব্র আওয়াজে চার দিক কেঁপে উঠছিল। হোটেলে ঘরের মধ্যে থেকেও নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছিল না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রাণ হাতে করে সারা রাত কাটিয়েছি। এখন শুধু ভাবছি, সেই রাতে দার্জিলিঙে না থেকে যদি মিরিকে থাকতাম!’’
বিপর্যয় পেরিয়ে সোমবার বাড়িতে ফিরতে পেরেছেন বাঘা যতীনের মহুয়া বসু, হাওড়ার শিবপুরের কৌশিক কোলে। পরিবার নিয়ে অক্ষত ফিরলেও শেষ ৪০ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা ভুলতে পারছেন না তাঁরা কেউই। এ দিন বিকেলেশিয়ালদহ স্টেশনে নামেন কৌশিক। জানালেন, সপ্তমীর দিন পরিবার ও বন্ধু-সহ মোট আট জনকে নিয়েডুয়ার্স, মূর্তি গিয়েছিলেন।
কৌশিক বললেন, ‘‘এক রাতে যেন সবটা বদলে গেল। পাহাড় জুড়ে এখন শুধু হাহাকার। যে দিকে তাকাচ্ছি, সে দিকে শুধু ধ্বংসের ছবি। কেউ যেন বিনা বাধায় পাহাড়ের উপরে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে গিয়েছে।’’ বাসে করে এ দিন সকালে ফিরেছেন বাঘা যতীনের মহুয়াও। তিনি বললেন, ‘‘যাদেখেছি, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই আতঙ্ক কত দিনে ভুলতে পারব, জানি না।’’
গত ২৯ সেপ্টেম্বর উত্তরবঙ্গে বেড়াতে গিয়ে দুর্যোগের মুখে পড়েন দুর্গাপুরের বাসিন্দা রুকা ভট্টাচার্য এবং মহুয়া চক্রবর্তীও। তাঁরাদুর্গাপুরের ডিএভি স্কুলের শিক্ষিকা। দার্জিলিং, তিনচুলে ঘুরে সুখিয়াপোখরির মিম চা বাগানের হোম স্টেতে উঠেছিলেন তাঁরা। রবিবার তাঁদের ফেরার কথা থাকলেও দুর্যোগে সেখানেই আটকে পড়েন। সুখিয়াপোখরি থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে এই মিম চা বাগান।
রুকা বলেন, ‘‘এই রাস্তাটা খুব একটা ভাল নয়, ভাঙাচোরা। তার পরে সুখিয়াপোখরির রাস্তায় ধস নামে। ফলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।’’ অবশেষে সোমবার সন্ধ্যায় শিলিগুড়ি থেকে ফেরার বাস ধরেছেন তাঁরা।