• খগেনের রক্তাক্ত মুখের ছবিতে উদ্বেগ-ক্ষোভ রাজ্য বিজেপির নিচুতলায়, মোদী এবং শাহের ‘ভূমিকা’ নিয়েও প্রশ্ন কর্মীদের!
    আনন্দবাজার | ০৭ অক্টোবর ২০২৫
  • আক্রান্ত হওয়া এই প্রথম নয়। তার জেরে দলীয় কর্মীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও প্রথম নয়। কিন্তু সোমবার নাগরাকাটায় সাংসদ খগেন মুর্মু এবং বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ আক্রান্ত হওয়ার পরে বিজেপির নিচুতলার ক্ষোভের অভিমুখ ঘুরে গিয়েছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দিকে।

    কেন্দ্রীয় নিরাপত্তার মধ্যেই দলের সাংসদ মার খেয়ে রক্তাক্ত হলে সাধারণ কর্মীদের কী দশা হবে, সোমবার ঘটনার পর থেকেই সেই প্রশ্ন মুখে মুখে ফিরতে শুরু করেছিল বিজেপির অন্দরমহলে। অনেকে খোলাখুলি সমাজমাধ্যমেও সেই ক্ষোভ ব্যক্ত করে ফেলেছিলেন। রাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পোস্ট সেই ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দিয়েছে বলেই উঁচুতলার আশা। তবে এখন নিচুতলার কর্মীরা তাকিয়ে, ওই বিষয়ে কেন্দ্র শেষ পর্যন্ত বড় কোনও পদক্ষেপ করে কি না সে দিকে।

    প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ‘প্রশাসনিক দক্ষতা’ নিয়ে সাধারণত বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা গর্বই করে থাকেন। মোদী-শাহ জুটির ‘নির্বাচনী রণকৌশলে’র উপরেও তাঁদের অগাধ আস্থা। ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে হারা সত্ত্বেও বাংলার বিজেপি কর্মীদের সে আস্থা টাল খায়নি। কিন্তু খগেনের রক্তাক্ত মুখমণ্ডলের ছবি এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীকে অসহায়ের মতো মার খেতে দেখে সেই আস্থা খানিকটা হলেও টলে গিয়েছে।

    সোমবার বিজেপির বিভিন্ন জেলা কমিটি বৈঠকে বসেছিল ত্রাণ সংগ্রহ অভিযান নিয়ে আলোচনা করতে। বিজেপি সূত্রের খবর, একাধিক জেলায় বৈঠকের পরিবেশ ছিল থমথমে। বৈঠক শেষে জেলা স্তরের নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় প্রাধান্য পেয়েছে ‘উদ্বেগ’। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও সাংসদ বা বিধায়কদের উপরে আক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। ঘটনাগুলির কোনও বিহিত হচ্ছে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্যের বিজেপি কর্মীদের বলছেন তৃণমূলের সঙ্গে ‘সম্মুখসমরে’ যেতে! উদ্বেগ এ নিয়েই। রাঢ়বঙ্গের একটি জেলার তরুণ বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘গ্রামাঞ্চলে আমাদের এমন অনেক কর্মী রয়েছেন, যাঁরা রাজ্য বা দেশের রাজনীতি নিয়ে অত ভাবেন না। নিজের বুথ বা নিজের গ্রাম ঘিরেই তাঁদের জগৎ। সেই কর্মীরাও খগেনদার রক্তাক্ত মুখের ছবি দেখে আতঙ্কিত।’’

    কেন্দ্রের ‘নিষ্ক্রিয়তা’র অভিযোগ সংক্রান্ত ক্ষোভের আঁচ সমাজমাধ্যমেও মিলেছে। বঙ্গ বিজেপির এক শীর্ষনেতার ‘ঘনিষ্ঠ সহযোগী’ সমাজমাধ্যমে খগেন এবং মোদীর মুখের ছবি পাশাপাশি পোস্ট করে প্রশ্ন করেছেন, ‘‘মোদীজি দেখুন, আপনারা এ রকম রক্তাক্ত হয়ে কোনও দিন পার্টি করেছেন কি?’’ কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজেপি ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক (বাড়ি ডুয়ার্সে) সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘‘খগেন মুর্মুর উপরে এই বর্বরোচিত হামলার পরেও দেশের এ যাবৎ সবচেয়ে দুর্বল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ বারও শুধু কাগুজে কিছু রিপোর্ট নিয়েই ক্ষান্ত থাকবেন বলে মনে হয়।’’

    গত দশ বছরে এ রাজ্যে বিজেপি কর্মীদের উপরে হামলার অনেক অভিযোগ উঠেছে। প্রাণহানির সংখ্যাও কম নয়। পাশাপাশিই কোথাও সাংসদ, কোথাও বিধায়ক, কোথাও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হেনস্থা হয়েছেন বলে বিজেপির অভিযোগ। কখনও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লেখা হয়েছে। কখনও লোকসভার স্পিকারকে চিঠি লিখে স্বাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ তোলা হয়েছে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের বিরুদ্ধে। দিল্লি রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে, কড়া মন্তব্য করেছে। তার পরে আর ‘বড় পদক্ষেপ’ করতে দেখা যায়নি। খগেন-শঙ্করের উপর হামলা নিয়ে আদৌ কোনও পদক্ষেপ করা হবে কি না, তা নিয়ে সোমবারেই সংশয় তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই সূত্রেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে মোদী-শাহের ভূমিকা নিয়ে।

    নীচের তলায় এই ক্ষোভের কথা বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বও টের পেয়েছেন। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, ‘‘একটা ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ক্ষোভের বিস্ফোরণ একটা ঘটে। আমাদের সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের অনেকে রাগের মাথায় কিছু কথা বলেছেন বা লিখেছেন। পরে বুঝেছেন, দল সবরকম ভাবে পাশে রয়েছে এবং এ ভাবে লড়াই করেই আমাদের দলকে এগোতে হবে।’’ ক্ষোভের যে ‘বিস্ফোরণ’ সোমবার বিকেল থেকে দেখা যাচ্ছিল বা সরাসরি মোদী-শাহের ভূমিকা নিয়ে এমন প্রশ্ন তোলা বেনজির কি না, প্রত্যাশিত ভাবেই রাহুল সে প্রসঙ্গে যেতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা সকলেই জানি, এই সরকারকে ক্ষমতায় রেখে বাংলায় স্বচ্ছ নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা এ-ও জানি যে, আমাদের লড়াই করেই এগোতে হবে। বিজেপি মার খেতে খেতেই এ রাজ্যে প্রাসঙ্গিক হয়েছে।’’

    তবে সোমবার রাতে মোদীর তাঁর পোস্টে যে ভাষায় তৃণমূলের সমালোচনা করেন এবং রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিন্দা করেন, তাতে নীচের তলায় কিছুটা হলেও হাওয়া বদলায়। বহু কর্মী-সমর্থক মোদীর পোস্টটি ‘শেয়ার’ করতে শুরু করেন। এই আশায় যে, প্রধানমন্ত্রী যখন এত ‘কঠোর শব্দ’ প্রয়োগ করেছেন, তখন কিছু একটা পদক্ষেপও করবেন।

    খগেনের উপর হামলার ঘটনায় আদৌ কেন্দ্রীয় স্তরে কোনও পদক্ষেপ করা হবে কি না, করা হলেও কী হবে, তা নিয়ে কর্মীরা দূরের কথা, রাজ্য নেতারাও নিশ্চিত নন। রাজ্য সভাপতির এনআইএ তদন্তের দাবি বা লোকসভার স্পিকারের রিপোর্ট চাওয়াতেই ‘পদক্ষেপ’ আটকে থাকবে কি না, তা নিয়েও জল্পনা রয়েছে। তার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আহত খগেনকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে পরিস্থিতি আরও ‘জটিল’ করে দিয়েছেন। মোদীর পোস্টে যে হাওয়া বদলেছিল, ‘কার্যকরী পদক্ষেপ’ না হলে তা আবার অভিমুখ বদলাবে কি না, সেটাই উদ্বেগ উঁচুতলায়।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)