• অধ্যাপকেরা ‘আরবান নকশাল’! ছাত্রদের মন বিষিয়ে দেন, শিক্ষকদের বেনজির আক্রমন আরএসএস-ঘনিষ্ঠ উপাচার্যের, নিন্দার ঝড় শিক্ষামহলে...
    আজকাল | ০৮ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: দেশের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে শাসক দলের মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। সেই গৈরিকীকরণের বিতর্কে এ বার নতুন মাত্রা যোগ করলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যোগেশ সিংহ। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তাঁর দেওয়া ভাষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে ‘আরবান নকশালদের’ সক্রিয়তা, অধ্যাপকদের বিরুদ্ধে পড়ুয়াদের ‘মন বিষিয়ে’ দেওয়ার অভিযোগ এবং ‘পিঞ্জরা তোড়’-এর মতো ছাত্র আন্দোলনকে ‘অকৃতজ্ঞতা’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দার ঝড় উঠেছে শিক্ষামহলে। উপাচার্যের এই মন্তব্যকে মুক্তচিন্তা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বশাসনের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন পড়ুয়া ও শিক্ষকদের একাংশ।

    গত ২৮ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞান ভবনে ‘ভারত মন্থন ২০২৫: নকশাল মুক্ত ভারত- মোদীর নেতৃত্বে লাল সন্ত্রাসের অবসান’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত এবং কেন্দ্রের শাসক দলের ঘনিষ্ঠ গবেষণা সংস্থা ‘ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর সঙ্গে এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটিস’। সেই মঞ্চ থেকেই উপাচার্য যোগেশ সিংহ তাঁর ২৪ মিনিটের ভাষণে এই বিতর্কিত মন্তব্যগুলি করেন। ভাষণের ভিডিও পরে তাঁর নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়।

    উপাচার্যের এই ভাষণকে ‘নজিরবিহীন’ এবং ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পড়ুয়াদের একাংশ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচিরও ডাক দেওয়া হয়েছে। 

    নিজের ভাষণে উপাচার্য সিংহ বলেন, আজকের নকশালবাদ আর জঙ্গল থেকে পরিচালিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরগুলিই তাদের নতুন বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ২০২৬ সালের মধ্যে নকশালবাদ নির্মূল করার প্রচেষ্টার প্রশংসা করার পরেই তিনি শিক্ষাঙ্গনে ‘আরবান নকশালদের’ অবাধ বিচরণ নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেন। তাঁর কথায়, “ওরা বুদ্ধিজীবীর মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। ওরা অধ্যাপক, চিকিৎসক বা সরকারি কর্মচারী যে কেউ হতে পারে, সাধারণত এরা গরিবদের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায়।” অর্থাৎ সোজা ভাষায় গরীবদের পক্ষে কথা বললেই তিনি নকশালবাদী।

    উপাচার্যের আরও অভিযোগ, “স্বপ্ন আর সারল্য” নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পড়ুয়াদের নির্দিষ্ট মতাদর্শের পথে চালিত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “ওরা পড়ায় না, বরং মগজধোলাই করে।” ২০১৬ সালের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ টেনে এনে ‘ভারত তেরে টুকড়ে হোঙ্গে, ইনশাল্লাহ ইনশাল্লাহ’-এর মতো স্লোগানের উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন তোলেন, “অধ্যাপকেরাই যদি এই ধরনের চিন্তার উৎস হন, তাহলে কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ হয়নি?” সমালোচকরা অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন সেই মামলায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যোগ নেই বহুদিন আগেই তার প্রমাণ মিলেছে।

    তবে উপাচার্য অবশ্য সত্যাসত্যের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেন প্রোপাগান্ডায়। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত চলচ্চিত্র পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘বুদ্ধা ইন আ ট্র্যাফিক জ্যাম’ ছবিটি দেখার পরামর্শ দিয়ে উপাচার্য দাবি করেন, ছবিটি দেখলেই বোঝা যায় কীভাবে অধ্যাপকেরা নিজেদের মতাদর্শগত অ্যাজেন্ডা পূরণের জন্য পড়ুয়াদের আবেগ নিয়ে খেলা করেন। তাঁর মতে, এই ‘নরম, অ্যাকাডেমিক ভাষা’-র আড়ালে আসলে দেশের প্রগতিকে বাধা দেওয়ার এক ভয়ঙ্কর চক্রান্ত লুকিয়ে আছে।

    উপাচার্যের মন্তব্যের পরেই বিতর্কের ঝড় শিক্ষামহলে। এই বয়ান আসলে বিজেপির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে নিজেদের পরীক্ষাগার বানানোর বৃহত্তর পরিকল্পনারই অংশ বলে মনে করছেন সমালোচকেরা। দিল্লির এক অধ্যাপক নবীন গৌড় এই মন্তব্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে থাকা কোনও ব্যক্তির “চূড়ান্ত অধঃপতন” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “এটি পশ্চাদগামী মনোভাব। বর্তমানে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় যে সমস্ত গুরুতর অ্যাকাডেমিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তা থেকে নজর ঘোরানোর অপচেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অস্বস্তিতে পড়ে এমন কোনও বিষয় যাতে শিক্ষকরা উত্থাপন না করেন তার জন্যই এমন মন্তব্য করা হচ্ছে।”

    শিক্ষামহলের মতে, উপাচার্যের এই ভাষণ আসলে একটি অশুভ সঙ্কেত। এর মাধ্যমে শুধু ভিন্নমতকেই দমন করার চেষ্টা হচ্ছে না, বরং অধ্যাপক ও পড়ুয়াদের মধ্যে একটি ভয় ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করা হচ্ছে। এই ধরনের বিভেদমূলক মন্তব্য শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে মত তাঁদের। 

    প্রসঙ্গত, শিক্ষামহলে আরএসএস বা বিজেপির শক্তি সীমিত। এই ধারণাকে বদলাতে বদ্ধপরিকর মোদি সরকার। সেই ধারা বদলাতে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইআইটিগুলির মাথায় সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের উপাচার্য পদে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ শিক্ষাবিদদের একটি বড় অংশের। অভিযোগ উঠেছে সিলেবাস বদল করে ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃতি বা বৈজ্ঞানিক ভাবধারার বদলে কুসংস্কার শেখানোরও। কিন্তু এত কিছুর পরেও শিক্ষাবিদদের মধ্যে খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সঙ্ঘের রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী ভাবধারা। সেকারণেই এবার অধ্যাপকদের নিশানা করছে তারা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মন্তব্যে তেমন প্রবণতাই দৃশ্যমান বলে মত সমালোচকদের।
  • Link to this news (আজকাল)