‘আমরা বাবার লোক’ বলে দলিত যুবককে পিটিয়ে খুন যোগীরাজ্যে, রাহুল গান্ধীর নাম বলতেই বর্বর অত্যাচার!...
আজকাল | ০৮ অক্টোবর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: এই মৃত্যু কি এড়ানো যেত না? উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলীতে এক দলিত যুবককে পিটিয়ে মারার ঘটনায় পুলিশের চূড়ান্ত গাফিলতির যে হিমশীতল চিত্র সামনে এসেছে, তা দেখে শিউরে উঠছে গোটা দেশ। সময়মতো পুলিশি হস্তক্ষেপ হলে হয়তো বাঁচানো যেত একটি তরতাজা প্রাণ। নাকি বিজেপির শাসনে দলিতদের নির্যাতিত হওয়াই নতুন নিয়ম? প্রশ্ন বিরোধীদের।
ঘটনার সূত্রপাত ২ অক্টোবরের রাতে। ফতেপুরের বাসিন্দা ৩৮ বছরের হরিওম পাসোয়ানকে ‘ড্রোন চোর’ সন্দেহে পিটিয়ে মারে উন্মত্ত জনতা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জেলায় ‘ড্রোন চোর’ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ এবং স্থানীয় গুজবের মাধ্যমে ছড়ানো এই তত্ত্বে বলা হচ্ছে, একদল দুষ্কৃতী ড্রোন উড়িয়ে ধনী বাড়ি চিহ্নিত করে রাতে হানা দিচ্ছে। এই গুজবের জেরেই গ্রামীণ ও আধা-শহুরে এলাকাগুলিতে গভীর সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। সাধারণ পথচারী, পরিযায়ী শ্রমিক বা ডেলিভারি কর্মীদেরও এই গ্যাং-এর সদস্য ভেবে বসছেন গ্রামবাসীরা। এমনিতেই বিজেপির বিরুদ্ধে হোয়াটসঅ্যাপে ভুয়ো খবর ছড়ানোর অভিযোগ নতুন নয়। সেই বিতর্কেই ঘি ঢেলেছে এই ঘটনা।
নেটমাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে হরিওমকে নৃশংস ভাবে মারধর করা হচ্ছে, বিবস্ত্র করে বেঁধে রেখে উন্মত্ত জনতা বিদ্রূপ করে বলছে, “আমরা বাবা’র লোক।” সাহায্যের জন্য শেষ আর্তনাদে হরিওমকে “রাহুল গান্ধী” বলে চিৎকার করতে শোনা যায়, আর তার পরেই তাঁর উপর নেমে আসে আরও নির্মম প্রহার।
প্রত্যক্ষদর্শী বয়ান অনুযায়ী, দীর্ঘক্ষণ এই মর্মান্তিক ঘটনা চললেও পুলিশ বারবার সাহায্যের আর্তি উপেক্ষা করেছে। রাত প্রায় ৯টা নাগাদ গাদাগঞ্জ এলাকার একটি ধাবার কাছে স্থানীয়রা হরিওমকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে দেখে ‘ড্রোন চোর’ বলে সন্দেহ করে। ভিড় জমতে শুরু করলে মণীশ যাদব নামে এক যুবক গাদাগঞ্জের এসএইচও দয়ানন্দ তিওয়ারিকে ফোন করে জানান, প্রায় ৬০ জন গ্রামবাসী এক ব্যক্তিকে ঘিরে ধরেছে এবং অবিলম্বে পুলিশের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। থানা থেকে ধাবার দূরত্ব দশ মিনিট। তা সত্ত্বেও ৪৫ মিনিট পর্যন্ত আসেনি পুলিশ।
শেষ পর্যন্ত রাত ৯টা ৪৮ মিনিটে পুলিশের একটি গাড়ি (পিআরভি ১৭৭০) ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। তাতে ছিলেন হোমগার্ড নরেন্দ্র যাদব এবং অনিরুদ্ধ তিওয়ারি। তাঁরা হরিওমকে জেরা করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে কথা শুনে বোঝা যায় ওই যুবক মানসিক ভাবে অসুস্থ। কিন্তু পুলিশ গাড়িতে করে তাঁকে উদ্ধার করতে অস্বীকার করেন সিনিয়র পুলিশকর্মী জয়সিংহ যাদব। অভিযোগ, তিনি বলেন, “গাড়ি চালু কর। জ্ঞান দিস না। যেখানে যেতে চায়, যেতে দে।” এরপরেই গ্রামবাসীদের ভিড়ের মধ্যে হরিওমকে ফেলে রেখে পুলিশ চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরেই হরিওম পালানোর চেষ্টা করলে উনচাহার থানা এলাকার ঈশ্বরদাসপুর গ্রামে ফের ধরা পড়েন। জনতা তাঁকে বেঁধে রেখে লাঠি ও বেল্ট দিয়ে নির্মম ভাবে পেটাতে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তাঁর গোপনাঙ্গে আঘাত করা হয় এবং যন্ত্রণায় চিৎকার করলে মুখে জল ঢেলে দেওয়া হয়। তিনি যখন “রাহুল গান্ধী” বলে চিৎকার করেন, তখন ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে ওঠে, “এটা বাবা’র এলাকা।”
রাত ১০টা ১২ মিনিট নাগাদ প্রেম সিংহ নামে আর এক পুলিশকর্মী ধাবার মালিককে ফোন করে জানান, তিনি রাতের খাওয়া সেরে আসছেন। সাহায্য যখন পৌঁছয়, হরিওম তখন অর্ধমৃত। পরে জনতা তাঁর দেহ একটি রেললাইনের কাছে ফেলে দেয়। পরদিন সকালে তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়, মাথায় ছিল গভীর আঘাতের চিহ্ন এবং বুক জুড়ে বেল্টের দাগ।হরিওম ফতেপুর থেকে রায়বরেলী এসেছিলেন উনচাহারের এনটিপিসি-তে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে কর্মরত তাঁর স্ত্রী পিঙ্কির সঙ্গে দেখা করতে। পিঙ্কির কথায়, তাঁর স্বামী মানসিক অসুস্থতার জন্য চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি বলেন, “আমার স্বামী শিক্ষিত এবং দয়ালু ছিলেন। ওঁরা ওকে পশুর মতো মেরেছে।” তিনি সমস্ত অভিযুক্তের কঠোরতম শাস্তি দাবি করেছেন।
পরের দু'দিনে এই ঘটনার তিনটি ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে। প্রথম ভিডিওতে দেখা যায় রেললাইনের ধারে পড়ে থাকা হরিওমের নিথর, রক্তাক্ত দেহ। দ্বিতীয়টিতে, জনতা তাঁকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে এবং “চোর-চোর” বলে চিৎকার করছে। কিন্তু তৃতীয় ভিডিওটি গোটা দেশকে নাড়িয়ে দেয়। ১ মিনিট ২১ সেকেন্ডের ওই ক্লিপে দেখা যায়, হরিওমকে বিবস্ত্র করে তাঁরই জামা দিয়ে বেঁধে ঊরু ও যৌনাঙ্গে আঘাত করা হচ্ছে। যন্ত্রণায় তিনি কাতরাচ্ছেন, আর হামলাকারীরা তাঁকে নিয়ে মশকরা করছে, মুখে জল ঢালছে এবং একে অপরকে “মারতে থাক” বলে উৎসাহ দিচ্ছে।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘিরে ইতিমধ্যেই তীব্র রাজনৈতিক শোরগোল পড়েছে যোগিরাজ্যে। বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী নিজে ফোন করে নিহতের বাবা গঙ্গাদীন এবং ভাই শিবমকে সমস্ত রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন বলে খবর। কংগ্রেস সূত্রে খবর প্রায় ১৫ মিনিট ফোনে কথা বলেন রাহুল।
পরদিন সকালে উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অজয় রাই ফতেপুরে নিহতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের বিরুদ্ধে “জঙ্গলরাজ”-এর অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেন, “আমরা বাবা’র লোক বলে চিৎকার করতে করতে ওরা ওঁকে মেরে ফেলল। পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখল আর ওঁকে মরার জন্য ফেলে রেখে গেল। এই সরকারে ঘৃণা আর অপরাধীরাই শেষ কথা বলে।”
গোটা ঘটনায় রীতিমতো ব্যাকফুটে বিজেপি। উপ-মুখ্যমন্ত্রী ব্রজেশ পাঠক ঘটনাটিকে “অত্যন্ত উদ্বেগজনক” আখ্যা দিয়ে কঠোর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রায়বরেলীর এসপি যশবীর সিংহ কর্তব্যে গাফিলতির জন্য উনচাহারের এসএইচও-সহ ছয় পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ড করেছেন বলে জানিয়েছেন। ১২ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১০ জনকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
তবে রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী যাই বলুন উনচাহারের বিধায়ক মনোজ কুমার পাণ্ডে অভিযোগ করেন, “কিছু নেতা শকুনের মতো মৃতদেহের অপেক্ষায় থাকে, রাজনীতি করার জন্য। এটা কোনও সর্বভারতীয় ইস্যু নয়।”নিহতের স্ত্রী পিঙ্কির দাবি, “আমার স্বামী চোর ছিলেন না। মানসিক ভাবে অসুস্থ হলেও সম্পূর্ণ নিরপরাধ ছিলেন। জনতা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ওঁকে নির্যাতন করেছে। ওঁকে যে কষ্ট দেওয়া হয়েছে, অপরাধীদেরও যেন সেই একই যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।”