• ক্লিনচিট দিয়েছিলেন বিজেপির মন্ত্রী, সেই প্রাণঘাতী কাশির সিরাপেই প্রাণ গেল আরও দুই শিশুর...
    আজকাল | ০৮ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: মধ্যপ্রদেশের ছিন্দওয়াড়ায় শিশুদের জন্য দেওয়া বিষাক্ত কাশির সিরাপ ‘কোল্ডরিফ’ মঙ্গলবার আরও দুই শিশুর প্রাণ কাড়ল। এর ফলে গত ৪৩ দিনে এই ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৭। মৃত দুই শিশুর নাম জয়শু যদুবংশী এবং বেদাংশ পাওয়ার। দুজনেরই বয়স ছিল দুই বছর এবং তারা কিডনি বিকল হওয়ার সমস্যায় ভুগছিল।

    দু'জনেরই মৃত্যুর কারণ ডাইথিলিন গ্লাইকল (ডিইজি) দ্বারা মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি। জিএমসিএইচ-এর চিকিৎসক আশিস লোথে বলেন, “ডিইজি মস্তিষ্কের টিস্যুতে আটকে যায় এবং তাকে কোনও ভাবেই ছেঁকে বের করা সম্ভব নয়।” তিনি আরও জানান, “এর অনুমোদিত মাত্রা ০.১ শতাংশ, কিন্তু ওই সিরাপে ডিইজি-র পরিমাণ ছিল ৪৮.৬ শতাংশ, যা সহনমাত্রার থেকে প্রায় ৫০০ গুণ বেশি।”

    নাগপুরের পুর ও স্বাস্থ্য আধিকারিকরা জানিয়েছেন, এখনও ১১টি শিশুর অবস্থা সঙ্কটজনক।

    পরাসিয়ার এসডিএম শুভম যাদব জানান, নিষেধাজ্ঞা জারির আগেই কোল্ডরিফের যে বোতলগুলি বিক্রি হয়ে গিয়েছে, সেগুলি খুঁজে বের করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমীক্ষা শুরু করা হয়েছে।

    প্রসঙ্গত, বিষাক্ত কফ সিরাপে একাধিক শিশুমৃত্যুর ঘটনায় অবশেষে নড়েচড়ে বসল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। রবিবার দেশের সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের স্বাস্থ্যসচিব এবং ড্রাগ কন্ট্রোল আধিকারিকদের নিয়ে একটি জরুরি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বসে কেন্দ্র। মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে ‘কোল্ডরিফ’ নামের একটি কফ সিরাপ খেয়ে অন্তত ১৪টি শিশুর মৃত্যুর পরেই এই পদক্ষেপ করা হল। পরীক্ষায় ওই সিরাপে ডাইইথিলিন গ্লাইকল নামে একটি বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি মিলেছে।

    বৈঠকে কফ সিরাপ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির উপর নজরদারি বাড়ানো, শিশুদের ক্ষেত্রে বুঝে-শুনে ওষুধ দেওয়া এবং ভবিষ্যতে এমন বিপর্যয় এড়াতে নজরদারি ব্যবস্থা আরও জোরদার করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রকের তরফে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সমস্ত ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাকে সংশোধিত ‘শিডিউল এম’ কঠোর ভাবে মেনে চলতে হবে, যার মধ্যে ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসেস’ নিয়মও রয়েছে। হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, নিয়ম না মানলে উৎপাদন ইউনিটের লাইসেন্স বাতিল করা হতে পারে।

    শিশুদের, বিশেষত ছোটদের, কফ সিরাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের আরও সচেতন হওয়ার জন্য রাজ্যগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কারণ, শিশুদের বেশিরভাগ সর্দি-কাশি নিজে থেকেই সেরে যায় এবং তার জন্য ওষুধের প্রয়োজন হয় না। ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সময়মতো তথ্য সংগ্রহ এবং ‘ইন্টিগ্রেটেড হেলথ ইনফরমেশন প্ল্যাটফর্ম’ ব্যবহার করে জনসচেতনতা বাড়ানোর উপরেও জোর দেওয়া হয়েছে।

    ফার্মাকোভিজিল্যান্স প্রোগ্রাম অফ ইন্ডিয়ার জাতীয় বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা তথা দিল্লির এইমস-এর ফার্মাকোলজির প্রাক্তন প্রধান ডাঃ ওয়াই কে গুপ্ত এই ঘটনাকে ‘গুরুতর এবং অপরাধমূলক গাফিলতি’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “এই রাসায়নিকগুলির কোনও নিরাপদ মাত্রা নেই। সামান্য পরিমাণও মারাত্মক হতে পারে। ওষুধ তৈরির কারখানায় এই রাসায়নিক থাকাই উচিত নয়।” তাঁর মতে, অনেক সময় সস্তার জন্য গ্লিসারিন বা প্রোপিলিন গ্লাইকলের মতো নিরাপদ উপাদানের বদলে ভুল করে ব্যবহার করা হয়, যা অমার্জনীয় ভুল। তিনি সতর্ক করে বলেন, “এই কফ সিরাপগুলি, দু’বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য, একেবারেই প্রেসক্রাইব করা উচিত নয়।”

    স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে খবর, এনসিডিসি, এনআইভি এবং সিডিএসসিও-এর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি কেন্দ্রীয় দল মধ্যপ্রদেশের ছিন্দওয়াড়া এবং মহারাষ্ট্রের নাগপুরের ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলি পরিদর্শন করেছে। অসুস্থ শিশুদের ব্যবহৃত ১৯টি ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এখনও পর্যন্ত পরীক্ষা করা ১০টি নমুনার মধ্যে ৯টিই গুণমানে উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু ‘কোল্ডরিফ’ কফ সিরাপের নমুনায় অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গিয়েছে।

    এর পরেই তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরমে অবস্থিত প্রস্তুতকারক সংস্থাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সিডিএসসিও সংস্থাটির উৎপাদন লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করেছে এবং ফৌজদারি মামলাও শুরু করা হয়েছে।

    ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এর ডিরেক্টর-জেনারেল ডাঃ রাজীব বহল পরামর্শ দিয়েছেন, “পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে শিশুদের কফ সিরাপ বা একাধিক ওষুধের মিশ্রণ দেওয়া উচিত নয়।”

    ডিরেক্টর জেনারেল অফ হেলথ সার্ভিসেস ডাঃ সুনীতা শর্মা শিশুদের উপর নির্বিচারে কফ সিরাপ ব্যবহারের বিপদ তুলে ধরে বলেন, “শিশুদের ক্ষেত্রে কফ সিরাপের উপকারিতা সামান্যই, কিন্তু ঝুঁকি অনেক বেশি।” তিনি জানান, এই বিষয়ে শীঘ্রই বাবা-মা, ফার্মাসিস্ট এবং ডাক্তারদের জন্য নির্দেশিকা তৈরি করা হবে।

    ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া, ডাঃ রাজীব রঘুবংশী, সমস্ত উৎপাদন সংস্থাকে জিএমপি-র সংশোধিত নিয়ম মেনে চলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।

    রাজস্থানের স্বাস্থ্যসচিব এদিন বৈঠকে জানান, তাঁদের প্রাথমিক তদন্তে ৪টি মৃত্যুর সঙ্গে কফ সিরাপের গুণমানের সরাসরি যোগসূত্র মেলেনি, তবে তদন্ত জারি রয়েছে। মহারাষ্ট্রের তরফে জানানো হয়েছে, নাগপুরের হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের সেরা চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে।
  • Link to this news (আজকাল)