মোদির নিন্দাতেও লাগাম নেই—‘সনাতন ধর্ম’-এর নামে প্রধান বিচারপতি গাভাইকে নিশানা করা অব্যাহত ডানপন্থী গোষ্ঠীর হামলা
আজকাল | ০৮ অক্টোবর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: সোমবার (৬ অক্টোবর) প্রধান বিচারপতি বি.আর. গাভাইয়ের ওপর জুতো ছোড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতা যদিও ঘটনাটিকে “সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো প্রচারের ফলাফল” বলে ব্যাখ্যা করেছেন, তবুও বিচারপতির বিরুদ্ধে ডানপন্থী, হিন্দুত্ব গোষ্ঠীর ক্রোধ ও আক্রমণ থামেনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে “অ্যান্টি-হিন্দু” বলে অভিযুক্ত করে অবমাননাকর, জাতিবিদ্বেষী ছবি ও মন্তব্য ছড়ানো হচ্ছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সোমবার রাতে ঘটনার নিন্দা জানালেও, হিন্দুত্ববাদীরা তাঁকেও “অম্বেদকরপন্থী” আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করছে।
ঘটনার জাতিবিদ্বেষী চরিত্র প্রকাশ্যে আসে যখন ডানপন্থী প্রভাবশালী ব্যবহারকারী ‘কিক্কি সিংহ’ এক এআই-নির্মিত ভিডিও পোস্ট করেন। ওই ভিডিওতে গাভাইকে একটি মাটির কলস মাথায় পরা অবস্থায় দেখানো হয়—একটি চিত্র যা প্রাচীন যুগে দলিতদের প্রতি আরোপিত অমানবিক অপমানের প্রতীক, যখন তাদের থুতু পর্যন্ত মাটিতে পড়তে দেওয়া হতো না। ভিডিওতে দেখা যায়, নীল রঙে আঁকা গাভাইয়ের মুখে জুতো মারা হচ্ছে। ৩০ হাজার ফলোয়ারের ওই অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওটি পোস্ট হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা ২,০০০ বারেরও বেশি রি-পোস্ট হয়, কিন্তু এখনও মুছে ফেলা হয়নি।
এই আক্রমণের সূত্র ধরা পড়ে খাজুরাহোর এক মন্দির সংক্রান্ত মামলায়। মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো মন্দিরে ভগবান বিষ্ণুর একটি ভগ্নপ্রায় মূর্তি পুনর্স্থাপনের দাবি জানিয়ে করা এক জনস্বার্থ মামলায় শুনানির সময় বিচারপতি গাভাই মন্তব্য করেছিলেন, “তোমরা যদি ভগবান বিষ্ণুর অগাধ ভক্ত হও, তবে প্রার্থনা করো, ধ্যান করো, তাকেই বলো ব্যবস্থা নিতে।” এই মন্তব্যের পর থেকেই হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় গাভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে।
যিনি জুতো ছোড়েন, সেই ড. রাকেশ কিশোর পরে সংবাদমাধ্যমে বলেন, তিনি “ঈশ্বরের নামে” কাজটি করেছেন এবং “কোনও অনুশোচনা” নেই তাঁর। এমনকি তিনি দাবি করেন, বিচারপতি গাভাই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করায় আর “দলিত” নন—“তিনি সনাতন ধর্ম ত্যাগ করেছেন, তাই দলিত পরিচয় হারিয়েছেন,” বলেন কিশোর।
এই বক্তব্যের পরও ডানপন্থী প্রভাবশালী ইউটিউবার অজিত ভারতী পোস্ট করেন, “এটাই শুরু। যদি অ্যান্টি-হিন্দু বিচারপতিরা হিন্দুদের অপমান করেন, তবে এরকমই প্রতিক্রিয়া পাবেন।” পরে তাঁর টুইট মুছে ফেলা হলেও ‘মিশন অম্বেদকর’-এর প্রতিষ্ঠাতা সুরজ কুমার বৌদ্ধ অ্যাটর্নি জেনারেল আর. ভেঙ্কটরামানির কাছে অজিত ভারতী ও ধর্মীয় বক্তা অনিরুদ্ধাচার্যের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা চালুর অনুমতি চেয়ে চিঠি পাঠান।
এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ঘটনার আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় #ImpeachCJI হ্যাশট্যাগে একটি সংগঠিত ঘৃণা প্রচার চলছিল। বিচারপতির মন্তব্যের পর দুই দিনের মধ্যেই অজিত ভারতী তাঁকে “হিন্দুবিদ্বেষী, নিকৃষ্ট বিচারপতি” বলে আখ্যা দেন এবং পৌরাণিক কাহিনিতে হিরণ্যকশিপুর সঙ্গে তুলনা টানেন।
সলিসিটার জেনারেল মেহতা বলেন, “আমি নিজে দেখেছি প্রধান বিচারপতি সব ধর্মের স্থানেই শ্রদ্ধার সঙ্গে যান। এটা এক জন প্রচারসন্ধানী ব্যক্তির কাজ বলে মনে হয়।” কিন্তু তাঁর এই মন্তব্য সত্ত্বেও ডানপন্থী প্রচার থামেনি।
হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘জাট অ্যাসোসিয়েশন’-এর এক পোস্টে প্রশ্ন তোলা হয়, “একজন সিজেআই কি দেশের ১০০ কোটি হিন্দুর থেকেও বড়?”অন্যদিকে, হিন্দুত্ববাদী ওয়েবসাইট OpIndia-র সম্পাদক নুপুর শর্মা এক ভিডিও বার্তায় বলেন, গাভাইয়ের মন্তব্য ছিল “হিন্দুদের প্রতি অবমাননাকর”, এবং “এই ঘটনার হিংসা বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে নয়, একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে।”
সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, তিনি সিজেআই গাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ঘটনাটি “অত্যন্ত নিন্দনীয়”। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যে ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলির ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি।
‘SagasofBharat’ নামে একটি অ্যাকাউন্ট মন্তব্য করে, “গাভাই যখন বিষ্ণুকে অপমান করেছিলেন তখন আপনি চুপ ছিলেন। এখন জুতো পড়তেই এত সহানুভূতি? আপনি শুধু ভীম আর্মির নেতা, হিন্দুদের নন।”আরেক জনপ্রিয় অ্যাকাউন্ট The Skin Doctor লেখে, “ঘটনার কারণ নিয়ে একটিও কথা বললেন না কেন, প্রধানমন্ত্রী?”অন্য এক ব্যবহারকারী গারভিত সেঠি মন্তব্য করেন, “গাভাই যখন হিন্দু সমাজকে অপমান করেছিলেন তখন আপনি নীরব ছিলেন, এখন আপনি অম্বেদকরপন্থী সেজেছেন।”
এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও সামনে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমবর্ধমান ঘৃণা, জাতিবিদ্বেষ এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি আক্রমণাত্মক মানসিকতা। মোদির নিন্দা ও সরকারের বক্তব্য সত্ত্বেও, হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থী গোষ্ঠীর আক্রমণ অব্যাহত, যা দেশের গণতান্ত্রিক ও ন্যায়বিচারমূলক পরিসরে এক গভীর উদ্বেগের সঙ্কেত বহন করছে।