কথায় বলে রাজনীতি বড় বালাই। আর সেই রাজনীতি এবার প্রমাণ করল বঙ্গ বিজেপি ও কেন্দ্রের একাধিক ব্যর্থতা ও অপদার্থতা। উত্তরবঙ্গ প্রবল বৃষ্টিতে বানভাসি এবং বিরাট ক্ষয়ক্ষতির মুখে। মৃত্যু মিছিল মানুষের, পশুর। দেহ ভাসছে, দেহের খোঁজ মিলছে না। এক একটা জায়গা ধুয়ে মুছে সাফ। চারিদিকে শুধু মানুষের হাহাকার আর আর্তনাদ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এই বিপর্যয়ে সত্যিই কি কেন্দ্র পাশে দাঁড়াবে? 'জাতীয় বিপর্যয়'-এর তকমা কি দেবে কেন্দ্র সরকার? নাকি খুড়োর কলের মত শুধুই রাজনীতি? গত কয়েকদিনে কিন্তু এই প্রশ্ন ঘুরছে বারে বারে। ঘুরছে, তার কারণও রয়েছে। কারণ হিসেবে অবশ্যই অন্যতম পাহাড়ের পরস্থিতি। গত কয়েকবছরে গেরুয়া শিবিরের নেতাদের মুখে বারেবারে পাহাড় নিয়ে নানা কথা শোনা গিয়েছে। ভোটের ফায়দাও গিয়েছে পদ্মশিবিরে। কিন্তু পদ্মশিবিরকে ভোট দেওয়ায় পাহাড়ের আদেউ কি লাভ হয়েছে কোনও? এবারেও উত্তরের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি পরিদর্শনে এসেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু, গিয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, সাংসদ রাজু বিস্তা-সহ একাধিক বিজেপি নেতা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফিরে গিয়ে উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্টও জমা দেবেন কেন্দ্রকে বলে জানিয়েছেন। তবে কি এই রিপোর্ট অনুযায়ী জাতীয় বিপর্যয় স্বীকৃতি পাবে নাকি কেন্দ্র সরকার, নাকি আরওঁ একবার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাজ্যের বিরোধী দল শুধুই রাজনীতি করে যাবে?
বলাবাহুল্য মন্তব্যই সার, উন্নয়নের বিষয়ে কতটুকু এগিয়ে এসেছে কেন্দ্র সরকার উত্তরবঙ্গ নিয়ে তা নিয়ে রয়েছে একাধিক প্রশ্ন। যার কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি আজও পর্যন্ত। উল্টে উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন নিয়ে রাজ্য বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ প্রকাশ্যে এসেছে, বিশেষত উত্তরবঙ্গের বিজেপির সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে। পূর্বেই দেখা গেছে, অন্তর্দ্বন্দের কারণে বিজেপি দলও ছেড়েছেন উত্তরবঙ্গের বিজেপি সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জন বার্লা। যা প্রশ্ন তুলেছে বিজেপির আভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো ও সংগঠন নিয়ে। বিজেপির অন্দরে যথেষ্ট চাপানউতোর ও বিভেদ সৃষ্টি হয়, ভাঙন ধরে বিজেপির উত্তরবঙ্গের সাংগঠনিক কাঠামোতেও। প্রশ্ন উঠছে, যেখানে উত্তরবঙ্গের দার্জিলিংয়ের সাংসদ রাজু বিস্তা রয়েছেন সেখানে উন্নয়নের ক্ষেত্রে এত সংকীর্ণতা কি কারণে?
যদি আমরা পূর্ব পরিস্থিতির স্মৃতিচারণ করি, তাহলে চিত্রটা পরিষ্কার। শুধু বাংলায় নয়, উত্তরপ্রদেশে কুম্ভের মেলাতেও যে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটেছে এবং বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে সেখানেও কেন্দ্র সরকার জাতীয় বিপর্যয়ের তকমা না দেওয়ার অমানবিক চিত্র এসেছিল প্রকাশ্যে। এই জায়গা থেকেই প্রশ্ন উঠছে কেন্দ্র সরকার এবং রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি কিংবা বিজেপি শাসিত রাজ্য গুলি সত্যি কি জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল নাকি কেন্দ্র সরকার ও বঙ্গ বিজেপি, তাদের রাজনীতি প্রধান উদ্দেশ্য মমতা ব্যানার্জিকে সরিয়ে বাংলার ক্ষমতায় বসা?
উত্তরবঙ্গের বন্যা কবলিত পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল দাঁড়ানোর বদলে রাজনীতি করার চিত্রটাও যথেষ্ট স্পষ্টভাবে প্রকাশ্যে এসেছে। সাধারণ মানুষের উদ্ধার কাজে নিজেদের যুক্ত না করে উলটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন উত্তরবঙ্গে বন্যা হওয়ার সাথে সাথে সেখানে পৌঁছলেন না এবং কেনই বা তিনি কলকাতায় কার্নিভালে যোগদান করলেন, তাই নিয়ে রাজনীতি করতেই বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে বঙ্গ বিজেপির নেতৃত্বকে। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মমতাকে যারপরনাই অপমানজনক কটুক্তি করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। বলাবাহুল্য, মমতার উত্তরবঙ্গে সফরে 'ঢিলেমি' বলে কটুক্তি করে রাজনীতি করেছেন, কিন্তু তাঁদের অতি উদ্যোগে বন্যা কবলিত এলাকাবাসীর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। সোমবার সকালে যখন মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ সফরে যাত্রা শুরু করলেন ঠিক সেই সময় সাত তাড়াতাড়ি নিজেদের রাজনীতিকে মজবুত করতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন দার্জিলিং মিরিক-সহ একাধিক জায়গায়। এই বিষয়গুলিকে পরপর সাজালে, খুব সহজেই বলা যেতে পারে যে বঙ্গ বিজেপি আদৌ কতটা মানবদরদী, নাকি আদতে নিজেদের রাজনীতির ময়দান শক্ত করতে এবং মসৃণ করতে তারা বেশি ব্যস্ত!
মমতা ব্যানার্জির উত্তরবঙ্গ সফরে এই বন্যা কবলিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যে, যেমন্টা তিনি বারেবারে করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ক্ষতি হওয়া মানুষদের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা এবং তাদের পরিবারের একজন সদস্যের জন্য চাকরি। কেন্দ্র সরকারের কোনওঁ সহযোগিতা ছাড়াই তিনি এই আর্ত মানুষদের ত্রানের জন্য বিবিধ ব্যবস্থা করেছেন এবং একই সঙ্গে তাঁদের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান যা মানুষের মৌলিক অধিকার তার জন্য তিনি গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
উত্তরবঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, এক ভয়াবহ নিম্নচাপ প্রবলভাবে ঘণীভূত হয় বঙ্গোপসাগরে এবং সেখান থেকেই ঘূর্ণাবর্তের মাধ্যমে ওড়িশা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড এবং শেষে বিহার এবং দক্ষিণ বঙ্গে কিছুটা এর প্রকোপ পড়ে এবং তারপরে এটি প্রবল শক্তি নিয়ে উত্তরবঙ্গে আছড়ে পড়ে। যার ফলেই এই বিপর্যয় নেমে আসে উত্তরবঙ্গে এবং বৃষ্টির পরিমাণ ৩০০ মিলিমিটার বা তার বেশি ১২ ঘণ্টায়। অনেকে প্রবল বর্ষণকে মেঘভাঙা বৃষ্টি বললেও, এ বিষয়ে আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, এ বৃষ্টি কোনওভাবেই মেঘভাঙা বৃষ্টি নয়। হাওয়া অফিস তার যুক্তিও দিয়েছে।
উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে রাজ্যের অন্যান্য বিরোধী দলগুলি মূলত কংগ্রেস, সিপিএম কেন্দ্র সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে যেন এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিকে জাতীয় বিপর্যয় তকমা দেওয়া হয় এবং কেন্দ্র সরকার অবিলম্বে সঠিক পদক্ষেপ নেয় আর্ত মানুষদের ত্রাণের জন্য। যদিও এই বিষয়ে কেন্দ্র সরকার কতটুকু সহযোগিতার হাত বাড়াবে তা নিয়ে যথেষ্টই সন্দেহ রয়েছে। কারণ এখনও পর্যন্ত দেশে প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেমনভাবে কোনও উচ্চবাচ্য করেননি উত্তরবঙ্গের বিপর্যয় নিয়ে। বলাবাহুল্য বঙ্গ বিজেপির ক্ষেত্রেও বাংলা শাসক দলকে কালিমা লিপ্ত করার জন্য এবং রাজনীতি করার জন্য ময়দানে কোমর নামা ছাড়া অন্য কোনও কাজ নেই। গেরুয়া শিবির অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কেন্দ্রকে কতটুকু আবেদন জানাবে বা পদক্ষেপ নেবে, ভাবনা রয়েছে তা নিয়েও।
বলাবাহুল্য, উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়ে রাজ্য বিজেপির দুই বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ এবং খগেন মুর্মু মানুষের রোষের মুখে পড়েন বিজেপির দুই নেতা। স্থানীয়দের বিক্ষোভের মুখে পড়েন সাংসদ ও বিধায়ক। প্রথমে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলেও তাঁদের সেই প্রয়াস কাজে আসেনি। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে থাকে। মারমুখী হয়ে ওঠেন বিক্ষোভকারীরা। এমনকী তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ শঙ্কর ঘোষকে জুতো নিয়ে তেড়ে যান বলেও অভিযোগ। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে দুই নেতাই গাড়িতে উঠে পড়েন।
কিন্তু জনতার ক্ষোভ তাতেও প্রশমিত হয়নি। তাঁদের বলতে শোনা যায়, সারাবছর না এসে এখন কেন এসেছেন? সেইসঙ্গে তাঁদের গাড়ি লক্ষ্য করে উড়ে আসতে থাকে ইট ও পাথর। দুই নেতার সঙ্গের দেহরক্ষীরা আটকানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। জানা গিয়েছে, এরমধ্যেই একটি ইট এসে লাগে সাংসদ খগেন মুর্মুর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে গিয়ে ঝরঝর করে রক্ত বেরোতে থাকে। ভেঙে যায় গাড়ির কাঁচ। আহত খগেন মুর্মুকে নিয়ে যাওয়া হয় চালসা মঙ্গলবাড়ির একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শিলিগুড়িতে। যেখানে কেন্দ্রের শীর্ষ নেতৃত্বদের মুখে তাদেরই দলের বিধায়কদের আহত হওয়ার ঘটনায় কোনরকম উদ্বেগ প্রকাশ বা মন্তব্য পর্যন্ত করেননি। যা নিয়ে উঠেছে একাধিক প্রশ্ন এবং বঙ্গ বিজেপির অন্দরে জন্মেছে প্রবল ক্ষোভ বলে বঙ্গ বিজেপি সূত্রে খবর। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গিয়েছিলেন খগেন মুর্মুকে হাসপাতালে দেখতে।
রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুনাল ঘোষ এ নিয়ে মন্তব্য করে বলেন, 'বিজেপি বরাবর শকুনের রাজনীতি করে আসছে। তাদের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মত কোনও সদিচ্ছা দেখা যায় না, শুধু মৃত্যুর রাজনীতি করা ছাড়া তাদের কোনও কাজ নেই।'
এ জায়গায় খুব স্পষ্ট বলা যেতে পারে, উত্তরবঙ্গের এই ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আদৌ কি কেন্দ্র সরকার 'জাতীয় বিপর্যয়'-এর তকমা দেবেন এবং আর্ত মানুষদের সহযোগিতার হাত বাড়াবেন? নাকি শুধু রাজনীতির ময়দান মসৃণ করা ও বাংলার মসনদ কেড়ে নেওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টা ও প্রবল লিপ্সাতেই ভোটের ময়দানে নামবে? ২০২৬ তো আর বেশি দূরে নেই!