একাধিক শিশু মৃত্যুর পরেও শিক্ষা নিল না কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক, শিশুদের অকাল মৃত্যুতে দেশজুড়ে 'কফ সিরাপ' নিয়ে বাড়ছে রহস্য
আজকাল | ০৯ অক্টোবর ২০২৫
গোপাল সাহা: দেশ জুড়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে রাজনীতির আঙিনায় চলছে একে অপরকে দোষ দেওয়ার পালা। আর বলি হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষ তথা শিশুরা। গত সাতদিন আগেই দেশজুড়ে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে ১১ জন শিশুর রহস্যময় মৃত্যুর কারণ। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে এই শিশুদের কিডনি বিকল হয়ে যায়। এবং প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য! এই শিশুরা সকলেই একই ধরনের কাশির সিরাপ খেয়েছিল।
এরপর এই ভয়ঙ্কর ঘটনাকে কেন্দ্র করে তদন্তে নেমেছে রাজ্য ও কেন্দ্র যৌথভাবে। কিন্তু সপ্তাহ কেটে গেলেও প্রশ্নের পাহাড় বেড়েই চলেছে। আসলে কী ছিল সেই সিরাপে, যা শিশুদের প্রাণ কেড়ে নিল?
“Coldrif”-এর কালো রহস্য এবার প্রকাশ্যে:
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের রিপোর্ট বলছে, মৃত শিশুদের সেবন করা মোট ১৯টি সিরাপের নমুনা সংগ্রহ করে ওষুধ পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে ১০টি নমুনার পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে, এবং তাতে দেখা গেছে, একটি নমুনা মারাত্মকভাবে দূষিত।
এই সিরাপটির নাম ‘Coldrif’, যা তৈরি করেছিল চেন্নাইয়ের কদমবাক্কমে অবস্থিত শ্রীসান ফার্মা সংস্থা। তামিলনাড়ুর পরীক্ষাগারে পাওয়া গেছে, সিরাপটিতে ব্যবহার করা হয়েছে ডাই–ইথাইলিন গ্লাইকল (DEG), যা এক প্রাণঘাতী শিল্প–রাসায়নিক। যা মানুষ সেবন করলে মারাত্মকভাবে কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে।
DEG ও ইথাইলিন গ্লাইকল (EG) কখনওই ওষুধে ব্যবহারযোগ্য নয়। অথচ আগেও ভারতের ভেতরে ও বাইরে এমন দূষিত সিরাপের কারণে বহু শিশুর মৃত্যু ঘটেছে।
ভেজাল ওষুধের কারণে ভারতের ভাবমূর্তিতে আঘাত বিশ্ব দরবারে!
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম জেনেরিক ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ। অথচ গত কয়েক বছরে সেই গৌরবময় অবস্থান এখন চরম প্রশ্নের মুখে। ২০২৩ সালে গাম্বিয়া সরকার অভিযোগ করেছিল যে, হরিয়ানার Maiden Pharmaceuticals–এর তৈরি সিরাপের কারণে ৬৯ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। একই বছর উজবেকিস্তান জানিয়েছিল, Marion Biotech–এর তৈরি কাশি ও জ্বরের ওষুধ খেয়ে মারা গেছে ১৮ শিশু। ২০২৪ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঘোষণা করে যে তামিলনাড়ুর Fourrts কোম্পানির তৈরি 'Cold Out' সিরাপে DEG ও EG–এর মাত্রা ছিল অনুমোদিত সীমার থেকে বহু গুণ বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক সংস্থা সস্তায় উৎপাদন করতে propylene glycol–এর পরিবর্তে এই বিষাক্ত DEG ব্যবহার করে, যা শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী, মানুষের ক্ষেত্রে নয়। স্বনামধন্য ফার্মাকোলজিস্ট চিকিৎসক সান্তনু ত্রিপাঠীর মতে, “যতদিন না সরকার প্রতিটি ব্যাচে এই ধরনের রাসায়নিক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করছে, ততদিন এ ধরনের বিপর্যয় থামবে না।”
কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি নিয়ে সত্যি কি সচেতন?
‘The Truth Pill: The Myth of Drug Regulation in India’-এর সহ–লেখক প্রশান্ত রেড্ডি বলেন, “উজবেকিস্তান ও গাম্বিয়া কাণ্ডের পরও আমাদের দেশে ওষুধে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় তেমন পরিবর্তন আসেনি। এটা অত্যন্ত হতাশার ও লজ্জা জনক।” স্বাস্থ্যমন্ত্রক অবশ্য দাবি করেছে, তারা ৬টি রাজ্যে ঝুঁকি–ভিত্তিক পরিদর্শন অভিযান চালাচ্ছে, যাতে ওষুধ উৎপাদনের ত্রুটি চিহ্নিত করা যায়।
২০২২ থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত, CDSCO–র অধীনে ৯০৫টি ওষুধ কারখানা পরীক্ষা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে — যেমন উৎপাদন বন্ধ, সতর্কবার্তা বা কারণ দর্শানোর নোটিশ। তবুও প্রশ্ন রয়ে যায়, যদি এত পরিদর্শন, এত নিয়ম থাকা সত্ত্বেও দূষিত ওষুধ বাজারে আসে, তবে কোথায় ব্যর্থ হচ্ছে ব্যবস্থা?
শোকস্তব্ধ মৃত শিশুদের পরিবারের আর্তি
১১টি পরিবার আজ শোক ও ক্ষোভে দগ্ধ। তাঁদের চোখে একটাই প্রশ্ন, “কাশির সিরাপ খেয়ে আমার সন্তানের মৃত্যু হল কেন? দায়ী কে?” এই প্রশ্ন শুধু ওই পরিবারগুলির নয়, আজ সমগ্র ভারতের। এক দেশের, যে দেশ বিশ্বের ওষুধ ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত, কিন্তু নিজের শিশুদেরই বাঁচাতে পারছে না।
সব শেষে বলা যেতে পারে, কাশির সিরাপ এখন শুধুই বাজারের সাধারণ ওষুধ নয়, এটি ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আয়নায় এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা।
যদি এখনই প্রতিটি উৎপাদন ব্যাচে কঠোর পরীক্ষার ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এই মর্মান্তিক কাহিনি আবারও ফিরে আসবে। হয়তো আরও অনেক শিশুর নিয়ে যাবে প্রাণ।