নিজস্ব প্রতিনিধি, জলপাইগুড়ি ও সংবাদদাতা, শিলিগুড়ি, ধূপগুড়ি ও ময়নাগুড়ি: প্রবল দুর্যোগে হারিয়েছে মাথাগোঁজার ঠাঁই। কিন্তু বিপর্যয় টলাতে পারেনি অধ্যাবসায়কে। ঘরদোর ভেঙেছে। তবে নিজেদের স্বপ্ন যাতে ভেঙে না যায়, সেজন্য মরিয়া ঝুমা, নয়ন, সঙ্গীতারা। বড় হয়ে ওদের কেউ ডাক্তার হতে চায়। কারও স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। কেউবা শিক্ষিকা হয়ে পড়াতে চায় নিজের গ্রামের স্কুলে। সেই স্বপ্নকে সার্থক করতেই ত্রাণ শিবিরে পলিথিনের ছাউনির নীচে মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিচ্ছে ওরা। বেশিরভাগ বই-খাতা ভেসে গিয়েছে জলের তোড়ে। ময়নাগুড়ির বেতগাড়ার ধন্যি মেয়েদের এই অধ্যাবসায়কে কুর্নিশ জানিয়েছেন প্রশাসনের আধিকারিকরা। আশ্বাস দিয়েছেন তাঁদের পাশে থাকার। এদিকে, একমাসও নেই মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার। কীভাবে পরীক্ষা দেবে ভেবে পাচ্ছে না পোড়াঝাড়ের শুভঙ্কর রায়। একা শুভঙ্কর নয়। দুর্যোগ বিধ্বস্ত পোড়াঝারের বহু ছেলেমেয়ে এই চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেই পড়েছে। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ। পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন কোচবিহার গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া ধূপগুড়ির গধেয়ারকুঠি গ্রাম পঞ্চায়েতের হোগলাপাতার বাসিন্দা সকুমার রায়। জলে ভেসে গিয়েছে বইপত্র। সামনে পরীক্ষা। রেল লাইনের ধারে তাঁবুতেই ঠাঁই নিয়েছেন। সেখানেই তাঁর চলছে পরীক্ষার প্রস্তুতি।
বেতগাড়ার ত্রাণ শিবিরে বাঁধের উপর কয়েকশো পলিথিনের ছাউনি। সবাই ত্রাণের সামগ্রী পেতে মরিয়া। এসবের মাঝেই পলিথিনের ছাউনির নীচে বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ছে ঝুমা মণ্ডল। চারেরবাড়ি নগেন্দ্রনাথ হাইস্কুল থেকে এবার মাধ্যমিক দেবে সে। বলল, বাড়িঘর সব ভেসে গিয়েছে। ঘরের জিনিসপত্র আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কয়েকটা বই বুকে আঁকড়ে কোনওমতে বাড়ি ছেড়েছিলাম। ত্রাণ শিবিরে বসে সেগুলোই পড়ছি। শিক্ষিকা হতে চায় ঝুমা। বাঁধেই দেখা মিলল আরএক ধন্যি মেয়ে সঙ্গীতা রায়ের সঙ্গে। তবে ওই বাঁধের ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেওয়া নয়ন রায়, সুজয় রায়ের মতো মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের উদ্বেগ কাটছে না। তাদের বক্তব্য, বইখাতা, নোটস যা ছিল সব ভেসে গিয়েছে।
জলপাইগুড়ি জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) বালিকা গোলে অবশ্য বলেছেন, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পড়ুয়াদের স্কুল থেকে বই দেওয়া শুরু হয়েছে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় বলেন, আমাদের দলের ছাত্র সংগঠনের তরফে দুর্গত পড়ুয়াদের বইপত্র দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে। ফ্রি কোচিং সেন্টার খোলা হয়েছে।
এদিকে, পোড়াঝারের শুভঙ্কর বলে, বই-খাতার সঙ্গে বিভিন্ন প্রজেক্ট জলে ভেসে গিয়েছে। কিছু বই-খাতা উদ্ধার করা গেলেও সব ভিজে গিয়েছে। ৩ নভেম্বর থেকে মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা শুরু। পরীক্ষার আগে কতটুকু পড়ার সুযোগ পাব, জানি না। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য রাজু মণ্ডল বলেন, এলাকায় যতজন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রয়েছে তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। শীঘ্রই সকলের বই-খাতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া সুকুমারের মা রিতা রায় বলেন, ছেলে পিজিতে থেকে পড়াশোনা করে। পুকুরে মাছ বিক্রি করে ছেলেকে পড়াচ্ছি। দুর্যোগে মাছ, ঘর সব শেষ। এখন কেমন করে ছেলের পড়াশোনা চালাব, জানি না। নিজস্ব চিত্র