• প্রবল বিপর্যয়ে অটুট ভালোবাসার বন্ধন, শতায়ু স্বামীকে আঁকড়ে বাঁধেই দিন কাটছে পুষ্পবালার
    বর্তমান | ১০ অক্টোবর ২০২৫
  • ব্রতীন দাস, বেতগাড়া (ময়নাগুড়ি): প্রবল দুর্যোগে নিশ্চিহ্ন ঘর। জলঢাকার জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে গৃহস্থালির জিনিসপত্র। তবে অটুট ওঁদের ভালোবাসার বন্ধন। বন্যায় প্রাণ বাঁচাতে গামছা পরে কোনওমতে পড়শিদের কোলে চেপে ঘর ছেড়েছেন শতায়ু টাট্টু রায়। তাঁর পিছু পিছু একবুক জল ভেঙে বাঁধে এসে আশ্রয় নিয়েছেন স্ত্রী পুষ্পবালা। পরনে মলিন কাপড়। সম্বল বলতে এটুকুই। বাঁধের উপর বাঁশের মাচায় স্বামীকে আঁকড়ে ধরে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। 

    বৃহস্পতিবার ময়নাগুড়ির আমগুড়ি পঞ্চায়েতের বেতগাড়া খাটোরবাড়িতে বাঁধের উপর দেখা মিলল ওই বৃদ্ধ দম্পতির। প্রচণ্ড গরমে বাঁশের মাচার উপর শুয়ে হাঁফাচ্ছেন টাট্টু। পাশে বসে অশক্ত শরীরে ভাঙা হাতপাখা দিয়ে তাঁকে হাওয়া করছিলেন পুষ্পবালা। বললেন, এই মানুষটাই আমার জীবনের সব। বাবাকে কুড়ি টাকা পণ দিয়ে সেই যে আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এল, তারপর থেকে ওঁকে ছেড়ে এক রাতও অন্য কোথাও কাটাইনি। দুর্যোগে ছেড়ে যাব কীভাবে? ত্রাণ শিবিরে পলিথিনের ছাউনির নীচে দমবন্ধ করা গরম। তাই দিনের বেলা বাঁধের উপর খোলা জায়গায় বাঁশের মাচার উপরেই বুড়োকে সামলে রাখি। রাতটুকু পলিথিনের নীচে কাটাই। 

    স্বামীর বয়স কত? পুষ্পবালার জবাব, একশো হবে। তবে ভোটার কার্ডে ৮০! স্ত্রীর কথা শুনে ফোকলা দাঁতে হাসেন টাট্টু। বলেন, ওর যখন ১৫ বছর বয়স, তখন বিয়ে করে আনি। সে কী আজকের কথা। ১৯৬৮ সালের বন্যাতেও ঘর ছাড়তে হয়েছিল। 

    বৃদ্ধ দম্পতির তিন ছেলে। দীনেশ্বর রায়, ধনেশ্বর রায় ও জিতেন রায়। বিয়ে করে প্রত্যেকেরই আলাদা সংসার। বড় ছেলে দীনেশ্বরের কাছে থাকেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। এতদিন টিনের ঘরেই জীবন কেটেছে। এবারই বাংলার বাড়ি প্রকল্পে ঘর মিলেছিল। এতদিনে মাথার উপর ছাদ হবে, এটা ভেবে হাসি ফুটেছিল টাট্টু ও পুষ্পবালার মুখে। কিন্তু বিপর্যয় তাঁদের মুখের সেই হাসি কেড়ে নিয়েছে। জলঢাকার স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে নির্মীয়মাণ ঘর। ফলে ঠাঁইহীন হয়ে পড়েছেন এই বৃদ্ধ দম্পতি। 

    পুষ্পবালা বলেন, একসময় দিনমজুরের কাজ করত স্বামী। তা দিয়েই কোনওমতে সংসার চলত। বয়স হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে কাজ করার ক্ষমতা কমে আসে। এখন তো হাঁটতেও পারে না। এর ওর কোলে-পিঠে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে হয়। জলঢাকার বাঁধ ভেঙে হু হু করে জল ঢুকছিল গ্রামে। ভাগ্যিস বড় ছেলে বাড়ি ছিল। পড়শিরাও এগিয়ে এসেছিল। না হলে যে কী হতো কে জানে! হয়তো জলের তোড়ে বুড়ো-বুড়ি কোথায় ভেসে যেতাম। 

    ময়নাগুড়ি থানার আইসি সুবল ঘোষ বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বেতগাড়া গ্রামের বহু পরিবার বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। পলিথিনের ছাউনির নীচে রয়েছে তারা। প্রশাসনের তরফে তাদের কাছে খাবার, পানীয়জল, ওষুধপত্র পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ওই বৃদ্ধ দম্পতিরও যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখেছি আমরা।  নিজস্ব চিত্র।
  • Link to this news (বর্তমান)