• পরিবেশ রাজনীতিকে সামনে না আনলে আরও উত্তরবঙ্গ ঘটবে
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১০ অক্টোবর ২০২৫
  • আজ থেকে ঠিক দু’বছর আগে, ২০২৩ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ভেসে গিয়েছিল তিস্তা নদীর উপর তিস্তা-৩ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নির্মিত বাঁধ। জলের তোড়ে মারা গিয়েছিলেন কমপক্ষে ৫৫ জন মানুষ। উচ্ছেদ হয়েছিলেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। উত্তরবঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে তখনই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। বিভিন্ন পরিবেশবিদরা যেকথা বহু বছর ধরে বলে চলেছেন – তিস্তা নদীর উপর একের পর এক বাঁধ দিয়ে বিপর্যয় ডেকে আনা হচ্ছে। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের গড়া বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রবোধ দিয়েছিল – নদীবাঁধ পুনর্নির্মাণের জন্য স্থানীয় মানুষের মতামত নেওয়া হবে।

    ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সেই বিশেষজ্ঞদের দল জানায় – ২০ বছর আগেই মতামত নেওয়া হয়ে গেছে। নতুন করে জনশুনানির দরকার নেই। পুঁজির যুক্তির কাছে হার মানল সাধারণ যুক্তিবোধ। ২০২৩ সালের অক্টোবরের সেই বিপর্যয়ের ১৬ মাসের মধ্যেই কেন্দ্র তিস্তা-৩ প্রকল্পে কাজের ছাড়পত্র দিয়ে দিল। তা নিয়ে বিশেষ হইচইও হল না। তিস্তা নদীতে বড় বড় বাঁধ দিয়ে ইতিমধ্যেই ডজন খানেকের বেশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা নেওয়া হয়ে গেছে। নানা মহলের আপত্তি, গ্রীন ট্রাইব্যুনালে মামলা, জনস্বার্থ মামলা – কোনোকিছুতেই সরকারকে টলানো যায়নি। উন্নয়নের যজ্ঞে অটল, অনড় সরকার পরিবেশে প্রভাবের মূল্যায়নের ধার ধারেনি।

    বিকাশের নেশায় যেমন ধর্তব্যের মধ্যে আসেনা সেবক-রংপো রেল প্রকল্পের বিপদের কথা। পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সিকিমের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করবে। ১৪টা পাহাড়ি সুড়ঙ্গের ভেতর এবং ২৮টা সেতুর উপর দিয়ে রেলপথ নির্মাণে বিপর্যয়ের কথা বারবার বলা হয়েছে। ভূকম্পপ্রবণ এই অঞ্চলে ভূমিধস এক স্বাভাবিক ঘটনা। একের পর এক বাঁধে তিস্তার জলস্তর বাড়ছে। এবছরেরই অগাস্ট মাসে বৃষ্টিতে একটা নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গপথের দেওয়াল ধসে গিয়েছিল। স্থানীয় অধিবাসীরাও বারবার আপত্তি জানিয়ে চলেছেন। তিস্তার জলে ভেসে যাওয়া, ধসে মারা যাওয়ার পাশাপাশি তাঁদের গ্রাস করেছে জলসংকটের আতঙ্ক।

    তাঁদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জলের প্রধান উৎস পাহাড়ি ঝর্ণা। সেই ঝর্ণার জল শুকিয়ে যাচ্ছে, নানা নির্মাণ কাজে দূষিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক জলও আজ দূষণের জেরে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের দাপট এমনই। পাশাপাশি সড়ক নির্মাণ, সম্প্রসারণের নামে পাহাড় কাটা, জঙ্গল সাফ করার কাজও অবাধে চলছে। ধস নেমে রাস্তা বন্ধ থাকলে পর্যটকদের কষ্ট নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন হয়। কিন্তু সেখানকার অধিবাসী মানুষ, প্রাণিকুল, প্রকৃতি-পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগ দেখা যায় না।

    বিধ্বস্ত বাড়ি, সেতু, পথঘাট। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষের শব, জলের তোড়ে বিপন্ন পশুর দল – এসবের সরাসরি সম্প্রচারের আর্থিক মূল্য জানে সংবাদমাধ্যম। জীবজগতের চরম বিপর্যয়কে কীভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির পুঁজি করা যায়, তা ভালো জানে রাজনীতিবিদরা। উন্নত দেশে নির্বাচনী প্রচারে রাজনীতিবিদরা বলেন পরিবেশ সংরক্ষণের কথা। কিন্তু আমাদের অচেতনের দেশে এসব ভাবা নেহাতই বাতুলতা। পরস্পরকে দোষারোপ করে, ঢাকঢোল পিটিয়ে ক্ষতিপূরণ দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষতি সামলে দেওয়ার দক্ষতাই আজ সবচেয়ে বড় কৃতিত্বের পরিচয়।

    কিন্তু প্রকৃতি-পরিবেশের দীর্ঘস্থায়ী ও আক্ষরিক অর্থে অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ বা লাঘব হবে কীভাবে? একেকটা বিপর্যয় আসে, কিছু আলোচনা হয়, কিন্তু ধ্বংসলীলা চলতেই থাকে, যার পোশাকি নাম ‘উন্নয়ন’। উন্নয়নের এমনি জাদু যে রাজ্যের উত্তরের মহা বিপর্যয়ের দিনেও রাজ্যের রাজধানীতে ‘কার্নিভাল’ নামক আলো ঝলমলে উন্নয়নের পক্ষেই রায় দেন শহুরে নাগরিক। উন্নয়ন নামক মোহে অন্ধ মানুষ দুদিন পরে সব ভুলে যান। কার্নিভাল থেকে পর্যটন, পাহাড়ে একের পর এক নির্মাণকাজ – সবই যখন শিল্প, তখন শিল্পী বা শিল্পবোদ্ধা হতে ক্ষতি কী? বিনিময়ে স্থানীয় মানুষ, জীবজগত, বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি – সবই তুচ্ছ।

    উৎসবে, পর্যটনে, নব নব নির্মাণ প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার ব্যবসাই সব। তাই পর্যটন কেন্দ্রে বিপর্যয়ে আটকে থাকা পর্যটকদের নিয়েই সংবাদমাধ্যম বেশি মাতে, কারণ ওঁরা তাদের গ্রাহক। কিন্তু বিপর্যয়ে ক্রমশ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া স্থানীয় অধিবাসীদের কথা বিশেষ উঠে আসে না। যাঁরা বারবার এই ‘উন্নয়ন’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, আপত্তি জানিয়ে চলেছেন, সরকারের নীতি নির্ধারণে তাঁদের মতের কোনো মূল্যই নেই। যেমন নেই তাঁদের বসবাস, জীবিকা, এমনকি জীবনের মূল্য। থাকলে সারা হিমালয় অঞ্চল জুড়ে ঘটে চলা একের পর এক বিপর্যয়ে, প্রাণহানিতেও শিক্ষা হয় না আমাদের।

    পর্যটন শিল্পের নামে পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ে বহুতল, সড়ক সহ নানা পরিকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের ফল ভোগ করতে হচ্ছে পাহাড়ের মানুষকে। বিপদ শুধু পাহাড়ের নয়, সমগ্র উত্তরবঙ্গের। নদীকে বেঁধে, পাহাড় কেটে, জঙ্গল সাফ করে, পাহাড়ি ঝোরার মুখ বন্ধ করে সর্বনাশের আয়োজন প্রায় সম্পূর্ণ। অসম্পূর্ণ কাজকে পূর্ণতা দিতে অবাধে নদীর পাথর লুঠ, নদী, নদীর পাড়, খাল দখল চলছে সারা উত্তরবঙ্গ জুড়ে। সেগুলোকে কেন্দ্র করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মাফিয়ারা। উত্তরবঙ্গের শহর, গ্রাম জুড়ে প্রাকৃতিক সম্পদ অবাধে লুঠের চিত্র চোখ কান খোলা রাখলে টের পাওয়া যায়।

    পার্বত্য অঞ্চলের বৃষ্টিতে তাই ভেসে যায় একের পর এক জনপদ, বন্যপ্রাণের জন্য সংরক্ষিত অঞ্চল। খোদ কোচবিহার শহরেই তোর্সা নদী অনেকখানি দখল হয়ে গেছে। জেলায় জেলায় রাস্তা নির্মাণ, সম্প্রসারণের নামে অবাধে গাছ কাটা চলছে। বদলে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের আবহাওয়া। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি উধাও হয়ে যাচ্ছে, গরম রীতিমত রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের শুষ্ক মালভূমি অঞ্চলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। কলকাতা ও আশেপাশে খুব গরম পড়লে বা বৃষ্টিতে জল জমলে সারা রাজ্যের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি দেওয়া হয়। উত্তরবঙ্গে হলে দেওয়া হয় না। কলকাতাকেন্দ্রিক সরকারি পরিকল্পনায় উত্তরবঙ্গ ব্রাত্য।

    প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি আমাদের যতখানি লোভ, তার ছিটেফোঁটা দরদ সেখানকার মানুষের প্রতি আছে কি? না আছে সরকারের, না ভ্রমণবিলাসী নাগরিককুলের। তাই কেবল উত্তরবঙ্গ কেন? রাজ্যের জঙ্গলমহল বলে পরিচিত পশ্চিমাঞ্চলে পর্যটনের নামে নানা রিসর্ট গড়ে ওঠে। প্রকৃতি-পরিবেশে তার প্রভাব, পরোক্ষে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকার উপরে প্রভাব নিয়েও ভাবা হয় না। যেমন সুন্দরবনে পর্যটন শিল্পের নামে দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট ডেকে আনা হচ্ছে। শুধু পর্যটন নয়। নদী দূষণ, জলসংকটে স্থানীয় মানুষের পেটে টান পড়ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ, ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে এক লুটেরার অর্থনীতি।

    বড় বড় কোম্পানি থেকে স্থানীয় মাফিয়ারা যার সঙ্গে যুক্ত। তাদের পিছনে থাকে সরকার, শাসক দলের মদত। বড় বড় প্রকল্পের কাজের বরাত থেকে এলাকার জঙ্গল, নদী, পাহাড়ের পাথর লুঠ, বালি লুঠের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অবৈধ আর্থিক লেনদেন। কেন্দ্রের শাসক দলের ঘনিষ্ঠ কোম্পানিগুলোর কাজের বরাত পাওয়া নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা চলছে। সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে সেই রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে বারবার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এই রাজ্যে লুটেরাদের সঙ্গে শাসক দলের ঘনিষ্ঠতা সর্বজনবিদিত। সহচরী পুঁজি এভাবেই আজ প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠকে গতিময় করেছে, আর তাকেই উন্নয়ন বলে আমাদের গেলানো হচ্ছে। কেন্দ্রের শাসক বিজেপি ছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের সরকার তথা শাসক দল এর সঙ্গে যুক্ত। আজ উত্তরবঙ্গের এই বিপর্যয়ের দায় ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো এড়াতে পারে না।

    বিপর্যয়ের কারণ ধামাচাপা দিতে তারা যা করছে সেটা অন্যায় নয়, জঘন্যতম অপরাধ। মুখ্যমন্ত্রী কার্নিভালে আমোদ করেই শুধু অসংবেদনশীলতার পরিচয় দেননি। অপরাধ ধামাচাপা দিতে অন্যদের দোষারোপ করছেন। ভূ-প্রাকৃতিক নিয়মেই অন্য রাজ্য বা দেশের জল এই রাজ্যে আসবে। এটা নতুন নয়। তিনি এমন প্রচার করছেন, যেন জলছাড়া হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে। জল বাঁধলেই ছাড়ার প্রশ্ন ওঠে। বড় বড় নদীতে বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখা, নদীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করার পরিণাম আজ টের পাওয়া যাচ্ছে।

    নদী, খালের স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ না করলে, জলাভূমি দখল, ভরাট না করলে নিকাশি ব্যবস্থা এমনভাবে বিপর্যস্ত হয় না। যেভাবে দল এবং সরকারের মদতে প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ, পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করা হচ্ছে তা শাসক এসব অপযুক্তি, অসংবেদনশীল আচরণ দিয়ে আড়াল করতে চাইছে। একইভাবে দেশজুড়ে এই ধ্বংসযজ্ঞের দায় কেন্দ্রও এড়াতে পারে না। বিকশিত ভারতে উন্নয়নের ঠ্যালায় বিপন্ন হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল। সব গুলিয়ে দিতে সোশাল মিডিয়ায় যুদ্ধে নেমেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

    এই নির্লিপ্ততা চরম বিপদ ডেকে আনছে। পরিবেশ রাজনীতিকে সামনে না আনলে শাসকের এই অপরাধ, নোংরামির রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না। পরিবেশ রাজনীতি কেবল পরিবেশ রক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সমাজের সকল স্তরে পরিবেশগত সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি পরিবেশগত সমস্যাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার একটি কাঠামো তৈরি করে।প্রাকৃতিক সম্পদে পুঁজির দখল বন্ধের দাবিকে সামনে আনতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার সর্বজনীন।

    প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যাঁরা প্রকৃতির সঙ্গে বাস করছেন, তাকে রক্ষা ও ব্যবহারের সামাজিক জ্ঞান যাঁদের জন্মগত – সেই জনগোষ্ঠীর বাসস্থান, জীবিকা, জীবন বিপন্ন করে উন্নয়ন হতে পারে না। পরম্পরাগতভাবে অরণ্যবাসী মানুষদের উচ্ছেদ করে, জমি কেড়ে কোনো প্রকল্প হতে পারে না। অরণ্যের অধিকার আইন যথাযথভাবে কার্যকরী করা দরকার। প্রাকৃতিক সম্পদে ব্যক্তি, কোম্পানি বা রাষ্ট্রের মালিকানা ও লুঠের অধিকারকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে। পুঁজি নির্দেশিত উন্নয়নের বিরুদ্ধে পরিবেশ, অধিকার আন্দোলনের বিকল্প রাজনৈতিক ভাষ্য আজ নির্মাণ করতেই হবে, যা শাসককে ভাবাতে, নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য করবে। চলতি বছরে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের সেই শিক্ষাই দিচ্ছে।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)