• সবুজ ধ্বংস, অবৈধ নির্মাণের জন্য পাহাড়ে বাড়ছে বিপর্যয়? উঠছে প্রশ্ন
    প্রতিদিন | ১০ অক্টোবর ২০২৫
  • বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: এক দশক আগের বিভীষিকা ফিরেছে। ২০১৫ সালের ১ জুলাই সেখানে ভূমিধসে ৩০ জনের প্রাণ যায়। এবার ৫ অক্টোবর ফিরেছে সেই কালো রাত। ঘুমন্ত অবস্থায় পাথর-মাটি চাপায় ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিধ্বংসী ভূমিধসের ওই ক্ষত সহজে জুড়ানোর নয়। স্বজন হারানো শোকে বৃহস্পতিবারও বিহ্বল ছিল পাহাড়ি উপত্যকা। শুধু মিরিক নয়। সুখিয়াপোখরি, বিজনবাড়ি জুড়েও একই পরিস্থিতি হয়েছে। ইতিমধ্যে বিপর্যয়ের কারণ জানতে শুরু হয়েছে ময়নাতদন্ত। ক্ষয়ক্ষতির বহর দেখে আতকে উঠে অনেকেই ঘটনাকে অস্বাভাবিক মনে করলেও বিশেষজ্ঞদের একাংশ ভিন্ন মত পোষণ করছেন। তাঁরা দার্জিলিং ও কালিম্পং পাহাড়ের ভূমিধসকে নিছকই প্রাকৃতিক ঘটনা বলে দেগে দিয়ে দায় সারতেও নারাজ। উলটে তাঁদের সতর্কতা পাহাড়ে বেপরোয়া ভাবে রাস্তা ও বহুতল নির্মাণ, সবুজ ধ্বংস বন্ধ না হলে আরও বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতে পারে।

    উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা সূত্রে জানা গিয়েছে, আশির দশক থেকে ভূমিধস দার্জিলিং ও কালিম্পং পাহাড়ে নিয়মিত বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এর আগে ভূমিধসের ঘটনা যে ঘটেনি তেমন নয়। কিন্তু এখনকার মতো প্রতি বছর, একাধিক হয়নি। পুরনো নথি থেকে জানা গিয়েছে, দার্জিলিং পাহাড়ের প্রথম বড় ধস নথিভুক্ত হয় ১৮৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। সেবার মৃত্যু হয় ৭২ জনের। এরপর ১৯৫০ সালের ১১ জুন দার্জিলিংয়ের জলাপাহাড়, লেবং, কাটাপাহাড়, হ্যাপি ভ্যালি, তিনধারিয়া এলাকায় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ১৯৮০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রিম্বিক, লোধামা, বিজনবাড়ি, দার্জিলিং শহরে ভয়াবহ ধস নামে। ২১৫ জনের মৃত্যু হয়। পরের কয়েক বছর ধস নামলেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে ৩০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের জেরে পাহাড়ের পাগলাঝোরা, রংটং, তিনধারিয়া, টুং, রংপো, সিংতাম এবং দার্জিলিং শহরে ফের ভয়াবহ ধস নামে। ১৫০ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালের ১ জুলাই মিরিকে ধসে মারা যায় ৩০ জন। কালিম্পংয়ে ৬ জন। এরপর প্রতি বছর বর্ষায় নিয়ম করে ধস নামছে। রাস্তা বন্ধ হচ্ছে। এবারও ব্যাতিক্রম হয়নি।

    কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি? উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান সুবীর সরকার বলেন, “জঙ্গল ধ্বংস, যেখানে সেখানে চা-বাগান তৈরি, অপরিকল্পিত বহুতল নির্মাণ, রাস্তা তৈরি, নিকাশি ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, যথেচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যবহার, তার উপর প্রবল বর্ষণ ধসের বিপদ বাড়িয়েছে।” একমত পাহাড়ের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা হরকাবাহাদুর ছেত্রী। তিনি জানান, “পাহাড়ে অস্বাভাবিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে অপরিকল্পিতভাবে প্রচুর রাস্তা হয়েছে। গার্ডওয়ালের ব্যবস্থা না করে রাস্তা তৈরি করায় ফাটল বেড়েছে।”

    এমনিতেই হিমালয়ের এই অংশ অত্যন্ত নবীন। এখানকার মাটি, পাথর নরম। ঝুরঝুরে। সেখানে ছয়-সাত তলা বাড়ি উঠছে। হোটেল হচ্ছে। পরিনতিতে বিপদ বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত চার দশকে দার্জিলিং-কালিম্পংয়ের পাহাড়ি এলাকায় ৪২টি বড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। সেটা কমবে তেমন সম্ভাবনা সামনে নেই বলেই দাবি সুবীর সরকারের। সম্প্রতি জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সমীক্ষাতেও একই আভাস মিলেছে। তারা জানিয়েছে কালিম্পং, কার্শিয়াং, দার্জিলিংয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ ধসপ্রবণ, বিপজ্জনক হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে তিনধারিয়া, লিম্বুধার, গিদ্দাপাহাড়, গয়াবাড়ি, পাগলাঝোরা। সুবীরবাবু জানান, “দার্জিলিং হিমালয়ে এই মুহুর্তে জনসংখ্যা বৃদ্ধি লাগামহীন। ১০.৬০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দার্জিলিং শহরের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় দু’লক্ষ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১১ হাজার মানুষের বসবাস। প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার বাইরের মানুষ শহরে যাতায়াত করে। বেড়েছে যানবাহন। ওই চাপের ফলে ভূমির পরিমান কমছে।”

    ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় পাইন, ফার, দেবদারুর জঙ্গল ধ্বংস হয়েছে। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তরের সিকিম কেন্দ্রের অধিকর্তা গোপীনাথ রাহা বলেন, “এখন পাহাড়ের খাড়া ঢালগুলোতেও গ্রাম-শহর সম্প্রসারিত হচ্ছে। এর ফলে পাহাড়ের পরিবেশ চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। দেড়শো বছর আগেও যে এলাকায় ভূমিধসের বিপদ দেখা যায়নি, এখন সেখানেই প্রতি বছর ধস নামছে।” পরিবেশ কর্মী অনিমেষ বসুর অভিযোগ, “অপরিকল্পিত নির্মাণের জেরে পাহাড়ে ফাটল বেড়েছে। দূরে থেকে পাহাড়ের গায়ে যে সাদা রেখাগুলো দেখা যায় সেগুলোই ফাটল। সেখানেই ধসের বিপদ বেড়েছে।” সেবক, কালিম্পং এলাকার পাহাড় পাললিক শিলা দিয়ে গঠিত। অত্যন্ত নবীন। অথচ এখান দিয়েই সিকিমের রংপো পর্যন্ত পাহাড়ের ভিতর টানেল কেটে রেলপথ তৈরি হচ্ছে। এর পরিনতি কি হবে ভবিষ্যৎ বলবে।
  • Link to this news (প্রতিদিন)