• তেজস্বীর যাদবের ‘প্রতি ঘরে চাকরি’র প্রতিশ্রুতি কি অলীক স্বপ্ন না বিহারের দেউলিয়া হওয়ার রসদ
    আজকাল | ১১ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: আরজেডি নেতা এবং বিহারের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদবের ‘প্রতিটি বিহারি পরিবারের জন্য একটি সরকারি চাকরি’র প্রতিশ্রুতিটি সুচিন্তিত এবং গণনা করা নীতির চেয়ে নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক নাটকের মতো শোনাচ্ছে।

    বিহারের রাজ্য বাজেট, আয় করার ক্ষমতা, সিএজি রিপোর্ট (মার্চ ২০২৫), নীতি আয়োগের সাম্প্রতিক মূল্যায়ন রিপোর্ট, রাজ্য সরকারের জাতিশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী, তেজস্বীর প্রাকনির্বাচন প্রতিশ্রুতি দেখনদারি ছাড়া কিছুই নয়। বিহারের জন্য সংখ্যা এখন আনুমানিক ১২ কোটি ৭০ লক্ষ। রাজ্যে পরিবারপ্রতি গড় জনসংখ্যা ৫.৪। এর অর্থ মোট দু’কোটি ৩৫ লক্ষ পরিবার রয়েছে বিহারে। রাজ্যের জাতিগত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত, জনসংখ্যার প্রায় ১.৫৭ শতাংশ। এটি হল কর্মরত সরকারি কর্মীদের  সংখ্যা। যাদের বেতন দিয়ে থাকে রাজ্য। 

    এখানে বাস্তব চিত্রটি সামনে আসছে। প্রতিশ্রুত লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, যা প্রতি পরিবারে একটি চাকরি অর্থাৎ রাজ্যকে দু’কোটি ৩৫ লক্ষ চাকরির জন্য বেতন দিতে হবে। ২০ লক্ষ (২০ লক্ষ) বর্তমান চাকরির পাশাপাশি রাজ্যকে আরও দু’কোটি ১৫ লক্ষ নতুন চাকরি তৈরি করতে হবে। বিহারের বেতন বা মজুরির জন্য বার্ষিক ব্যয় ৪৫,০০০ কোটি টাকারও বেশি। প্রতি সরকারি কর্মীর গড় বার্ষিক বেতন ব্যয় প্রায় ২.২ লক্ষ টাকা। আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটি বিহারি পরিবারের জন্য একটি সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক বলে মনে হয়।

    বিহারে সরকারি চাকরিকে এখনও স্থিতিশীলতা এবং সম্মানের বলে মনে করা হয়। সেই রাজ্য এই প্রতিশ্রুতি নিঃসন্দেহে সেই জায়গায় গিয়ে আঘাত করতে পারে। তেজস্বী জনগণের কাছে তার প্রাক-নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে অতিরিক্ত দু’কোটি ১৫ লক্ষ সরকারি চাকরি তৈরির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। যা বর্তমান সরকারি কর্মীর সংখ্যার দশ গুণেরও বেশি। এমনকি বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের ১২ লক্ষ চাকরির প্রতিশ্রুতিকেও অবাস্তব বলে উপহাস করা হয়েছিল। এই নতুন প্রতিশ্রুতি কল্পনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অর্থনৈতিক আত্ম-ধ্বংসের দিকে এক কদম বলে মনে হচ্ছে।

    ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে বিহারের প্রায় ২০ লক্ষ কর্মীর বেতন ও মজুরি জন্য প্রায় ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ কোটি টাকা ব্যয় হয় বলে অনুমান। এর ফলে প্রতি বছর কর্মী প্রতি গড় খরচ ২.১৭ থেকে ২.২ লক্ষ টাকা। তেজস্বীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দু’কোটি ১৫ লক্ষ নতুন চাকরি তৈরি করলে বার্ষিক ব্যায় গিয়ে দাঁড়াবে ৪.৬ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি।

    বিহার বাজেট ২০২৪-২৫ এর বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি অনুসারে, রাজ্যটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যয়ের জন্য ৯২,৮৮২ কোটি টাকা ব্যয় করবে বলে অনুমান করা হয়েছে। যা আনুমানিক রাজস্ব আয়ের ৪১ শতাংশ। এর মধ্যে রয়েছে বেতনের জন্য ব্যয় (রাজস্ব আয়ের ১৮ শতাংশ), পেনশন (১৪ শতাংশ) এবং সুদ প্রদান (৯ শতাংশ)। ২০২৪-২৫ সালে, বেতনের জন্য ব্যয় ২০২৩-২৪ এর সংশোধিত অনুমানের তুলনায় ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। 

    এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে বিহারের মোট রাজস্ব ব্যয় প্রায় ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা। যার মধ্যে বেতন, পেনশন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিকাঠামো এবং কল্যাণ অন্তর্ভুক্ত। প্রস্তাবিত বেতন বিল রাজ্যের পুরো বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ হবে। এটি প্রায় স্কুটার কেনার ঋণে একটি জাম্বো জেট কেনার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মতো।

    এ তো সবে শুরু অথবা এটিকে হিমশৈলের চূড়া হিসেবে দেখা যেতে পারে। একবার পেনশন, প্রশাসনিক খরচ এবং নিয়োগ খরচ যোগ করলে, রাজস্বের অঙ্ক ধারণার বাইরে গিয়ে দাঁড়াবে। সিএজি (মার্চ ২০২৫) রিপোর্টে ইতিমধ্যেই বিহারের ক্রমবর্ধমান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছে। রিপোর্টে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে রাজস্ব আয়ের ৭০ শতাংশেরও বেশি বেতন, পেনশন এবং সুদ পরিশোধে খরচ হয়।

    নীতি আয়োগ, বিহারের জন্য তাদের সর্বশেষ সারসংক্ষেপ রিপোর্টে জানিয়েছে, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে রাজ্যটিকে শেষ স্থানে রয়েছে। এর ফলে নতুন আর্থিক বোঝা চাপানোর জন্য জায়গা খুব কম। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “২০২২-২৩ সালের হিসেবে বিহারের বার্ষিক বেকারত্বের হার ৩.৯ শতাংশ। যা জাতীয় গড় ৩.২ শতাংশের থেকে কিছুটা বেশি।”

    এতে আরও বলা হয়েছে, "২০১২-১৩ থেকে ২০২১-২২ সালের মধ্যে বিহারের প্রকৃত আভ্যন্তরীণ উৎপাদন গড়ে ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা একই সময়ের জাতীয় গড় ৫.৬ শতাংশের চেয়েও কম। গত তিন দশকে, জাতীয় জিডিপিতে বিহারের অংশীদারি ১৯৯০-৯১ সালে ৩.৬ শতাংশ থেকে কমে ২০২১-২২ সালে ২.৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০২১-২২ সালে এর নামমাত্র মাথাপিছু আয় ছিল জাতীয় মাথাপিছু আয়ের মাত্র ৩০ শতাংশ।”

    এই ধরণের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি সব সময় অঙ্ককে উপেক্ষা করে যায়। তেজস্বীর ঘোষণা শুনতে ভাল লাগলেও, তা কতটা বাস্তবায়িত করা সম্ভব, সন্দেহ প্রবল। কীভাবে এই বিপুল অর্থনৈতিক বোঝা সামাল দেওয়া হবে তা নিয়ে কোনও শব্দ খরচ করেননি তিনি। ‘প্রতি ঘরে সরকারি চাকরি’ শুধু স্লোগান নয়, একটি দায়বদ্ধতাও। যদি কোনও সরকার সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করে তাহলে তা বিহারকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে পারে। 
  • Link to this news (আজকাল)