নীতীশ কুমারের দুই দশকেরও বেশি শাসনকালে ভয়াবহ চিত্র উঠে এল বিহারের!...
আজকাল | ১১ অক্টোবর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিহারে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন রাজ্যের দলিত সম্প্রদায়ের করুণ বাস্তবতাকে সামনে এনেছে। জাতীয় দলিত ও আদিবাসী সংগঠনের কনফেডারেশন (ন্যাকডাওর) ৮ অক্টোবর দিল্লির প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বিহার – হোয়াট দলিত ওয়ান্ট’ শিরোনামের একটি বিস্তারিত সমীক্ষা প্রকাশ করে। এই সমীক্ষা স্পষ্ট করে জানিয়েছে, নীতীশ কুমারের ২০ বছরের শাসনকালেও বিহারের দলিতরা রাজ্যের উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
সমীক্ষাটি বিহারের প্রায় ২৫টি জেলায় ১৮,৫৮১টি দলিত পরিবারের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে। পাটনা, গয়া, মুজফ্ফরপুর, পশ্চিম চম্পারণ, মোতিহারি ও দরভঙ্গা-সহ বড় বড় জেলাগুলিতে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বিশেষ বিষয় হল, এই সমীক্ষায় তথ্য সংগ্রহের কাজেও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষই অংশ নেন।
ন্যাকডাওরের প্রধান অশোক ভারতী সংবাদমাধ্যমকে জানান, “বিহারে প্রতি নির্বাচনে দলিতদের কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করা হয়। উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, জমি ও বাসস্থানের প্রশ্নে দলিতদের বাস্তব অভিজ্ঞতা কোনও রাজনৈতিক আলোচনায় স্থান পায় না।” তিনি আরও বলেন, “জুলাই থেকে আগস্ট ২০২৫-এর মধ্যে ২৫টি জেলায় ১৮ হাজারেরও বেশি পরিবারে গিয়ে আমরা দেখেছি, যাঁদের নামে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, বাস্তবে তারাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত। এই প্রতিবেদনটি বিহারের রাজনীতির জন্য একটি আয়না, যা দেখায় যে প্রতি পাঁচজন বিহারির মধ্যে একজন দলিত হলেও তাঁদের সমস্যাই সবচেয়ে অবহেলিত।”
নীতীশ কুমারকে ‘উন্নয়নের পুরুষ’ হিসেবে প্রচার করা হলেও বাস্তব পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন, বলে দাবি করেন অশোক ভারতী। তিনি জানান, “নীতীশ কুমারের দুই দশকের শাসনেও বিহারের ৬২ শতাংশ দলিত আজও অশিক্ষিত, এবং ৬৩ শতাংশ বেকার। তাঁদের মাসিক গড় আয় মাত্র ৬,৪৮০ টাকা।” আরও জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দলিতদের জন্য বিহার সরকারের বাজেট বরাদ্দ ছিল ২.৫৯ শতাংশ, যা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.২৯ শতাংশে। অশোক ভারতীর প্রশ্ন, “যখন প্রতিটি পঞ্চম বিহারবাসী দলিত, তখন নীতীশ কুমারের ‘সুশাসনে’ তাঁদের জায়গা কোথায়?”
প্রতিবেদনে দলিতদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, ভূমি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং তাঁদের উপর হওয়া অত্যাচার ও হিংসার বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি দলিতদের জনসংখ্যা ও সামাজিক গঠন নিয়েও তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে মোট ২০টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ২৫০টি দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, যাতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার দলিত, আদিবাসী ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির উন্নয়নের জন্য বিদ্যমান প্রকল্পগুলিকে পুনর্গঠন করতে পারে।
আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ন্যাকডাওর সমস্ত রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানিয়েছে, যেন তারা নিজেদের নির্বাচনী ইস্তাহারে এই ২০টি প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে। এর মধ্যে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন, সরকারি চাকরিতে বৈষম্য দূর করা, এসসি ও এসটি মহিলাদের শিক্ষায় বিশেষ জোর দেওয়া এবং দলিত ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের নিশ্চয়তা দেওয়া।
রাষ্ট্রীয় মুশাহার পরিষদের সদস্য উমেশ কুমার মাঞ্জি জানান, “উন্নয়নের নামে বিহারে রাস্তা ও বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে হাজার হাজার দলিত পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে কোনও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়াই। আমার নিজের বাড়ি গত ডিসেম্বর মাসে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোথাও থাকার জায়গা দেওয়া হয়নি।” তিনি আরও বলেন, “আজও আমরা ১৯৭০-এর দশকের মতো রাস্তার ধারে কুঁড়েঘরে বসবাস করছি। আমাদের শৈশব, সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধন সবই হারিয়ে গেছে। বাস্তুচ্যুত না হলে এই যন্ত্রণার গভীরতা কেউ বুঝবে না।”
নীতীশ কুমারের ২০ বছরের শাসনকে ব্যর্থতা হিসেবে বর্ণনা করে উমেশ মাঞ্জি বলেন, “লালু প্রসাদের আমলে অন্তত আমরা মাথা উঁচু করে কথা বলতে শিখেছিলাম, বাড়ি পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেই সাহস ও মর্যাদা দুটোই কেড়ে নেওয়া হয়েছে।”
বিহারে নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের তরফে ঘোষিত ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ বা বিশেষ নিবন্ধন পর্যালোচনা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। ন্যাকডাওরের কর্মকর্তারা জানান, এই প্রক্রিয়ার দলিত ও আদিবাসী ভোটারদের উপর প্রভাব নিয়ে তদন্ত এখনো চলছে এবং তার ফলাফল পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করা হবে।
প্রতিবেদনটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে বিহারের তথাকথিত উন্নয়নের আড়ালে এক বৃহৎ দলিত জনগোষ্ঠী আজও দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বেকারত্ব ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার। তাদের জীবনযাত্রার উন্নতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিশ্রুতি কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ।