• প্রধান বিচারপতি গাভাই-এর উপর জুতো ছোড়া আসলে ভারতের সংবিধানের ওপর এক গভীর আঘাত ...
    আজকাল | ১১ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের প্রধান বিচারপতি (সিজেআই) দীপক মিশ্র গাভাইয়ের উপর সুপ্রিম কোর্টে ছোড়া জুতো দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর উপর লুকিয়ে থাকা জাতিভিত্তিক সামাজিক বাস্তবতার এক নগ্ন প্রতিচ্ছবি প্রকাশ করেছে। ঘটনাটি ঘটিয়েছেন ৭১ বছর বয়সী হিন্দু আইনজীবী রাকেশ কিশোর, যিনি আদালতকক্ষে জুতো ছুড়তে ছুড়তে চিৎকার করেছিলেন—“ভারত সনাতন ধর্মের অপমান সহ্য করবে না।” তাঁকে আটক করার পরেও কিশোরকে একাধিক সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যমে নিজের মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা আরও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

    এই সাক্ষাৎকারগুলিতে স্পষ্ট হয়েছে, কিশোরের ক্ষোভের মূল লক্ষ্য ছিলেন বিচারপতি গাভাই নিজে—ভারতের দ্বিতীয় দলিত প্রধান বিচারপতি এবং প্রথম দলিত বৌদ্ধ যিনি দেশের সর্বোচ্চ বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত। তিনি বিচারপতিকে “মাই লর্ড” বলা নিয়ে তীব্র আপত্তি জানান এবং এমনকি তাঁকে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেন কীভাবে আদালতে শালীনভাবে একটি পিটিশন খারিজ করা উচিত। এই পিটিশনটি ছিল খাজুরাহোর এক মন্দিরে বিষ্ণুমূর্তি পুনঃস্থাপনের দাবি নিয়ে, যা প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা দপ্তরের (এএসআই) তত্ত্বাবধানে থাকা একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। তবে কিশোরের ক্ষোভের গভীরে রয়েছে অন্য একটি বিষয়—সুপ্রিম কোর্টের ২০২৪ সালের ‘বুলডোজার রায়’, যেখানে আদালত ঘোষণা করেছিল যে স্থানীয় প্রশাসন কোনওভাবেই গণদণ্ড হিসেবে বাড়িঘর ভাঙতে পারবে না। বিচারপতি গাভাই সম্প্রতি মরিশাসে ভাষণ দিতে গিয়ে এই রায়কে “আইনের শাসনের জয়” হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, যা কিশোর ও তাঁর মতো হিন্দুত্ববাদী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

    প্রধানমন্ত্রীর তরফে ঘটনাটির নিন্দা জানানো হলেও, হিন্দুত্বপন্থী সংবাদপোর্টাল ও সম্পাদকরা প্রকাশ্যে কিশোরের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা দাবি করেছেন, বিচারপতি গাভাইকে তাঁর মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। এমনকি একজন ডানপন্থী সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাবশালী, যিনি গাভাইয়ের বিরুদ্ধে জনসমাবেশে হামলার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও পরে ক্ষমা প্রার্থনার পর মুক্তি দেওয়া হয়। সামাজিক মাধ্যমে বিচারপতি গাভাইকে নিয়ে জাতিবিদ্বেষী ও উস্কানিমূলক ভিডিওর বন্যা বয়ে যায়, যার বিরুদ্ধে অবশেষে এফআইআর দায়ের হয়েছে।

    এই ঘটনাটি দেখায়, বিচারপতি গাভাইয়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুধু তাঁর জাতিগত পরিচয়ের কারণে নয়, বরং তাঁর সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও। তিনি যে ধরনের সুপ্রিম কোর্ট কল্পনা করেন—একটি আদালত যা সংবিধানের শাসন ও ন্যায়নীতির উপর ভিত্তি করে, এবং যা রাষ্ট্রকে জনতার ওপর ‘বুলডোজার রাজনীতি’ চালাতে বাধা দেয়—তা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রচিন্তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে।

    ভারতের সংবিধান এক অভূতপূর্ব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল—সমতা ও ন্যায়ের আইনি নিশ্চয়তা এমন এক সমাজে যেখানে সামাজিকভাবে তা কখনও চর্চিত হয়নি। তাই আরএসএস-এর মতো সংগঠনগুলো সংবিধানকে প্রথম থেকেই “বিদেশি” বলে আখ্যা দেয় এবং মনে করে, প্রকৃত ভারতীয় সংবিধান হওয়া উচিত মনুস্মৃতি ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের ভিত্তিতে, যেখানে জাতি ও লিঙ্গের শ্রেণিবিন্যাস স্বীকৃত থাকবে।

    সংবিধান প্রণেতারা জানতেন তাঁরা এক বৈষম্যমূলক সমাজে সমতার ধারণা চাপিয়ে দিচ্ছেন। ড. বি.আর. আম্বেদকর ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর সংবিধান সভায় বলেছিলেন, “২৬ জানুয়ারি ১৯৫০-এ আমরা এক বৈপরীত্যময় জীবনে প্রবেশ করব—রাজনীতিতে সমতা, কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে বৈষম্য।” তবু ভারতের সাধারণ মানুষ সংবিধানের এই সীমিত প্রতিশ্রুতিকেও উচ্ছ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন এবং ন্যায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।

    ভারতের সাংবিধানিক আদালত তাই কেবল আইনি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সামাজিক ক্ষেত্র, যেখানে বঞ্চিতরা বারবার ন্যায়ের আশ্রয় খুঁজেছেন। এর ফলেই আজও লাখ লাখ ভারতীয় তাঁদের স্থানীয় প্রতিনিধি বা পুলিশে বিশ্বাস না রাখলেও সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন—যা সংবিধানকে তাঁদের জীবনের অংশ করে তুলেছে।

    এ কারণেই বিজেপি ২০২৪ সালের নির্বাচনে “৪০০ পার” স্লোগান দিয়ে সংবিধান সংশোধনের ইঙ্গিত দিলে তা জনরোষ ডেকে আনে এবং দলটি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। তাই এখন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে সাংবিধানিক আদালতগুলোই—যেখানে সংবিধানের অর্থ, মূল্যবোধ ও সীমা নির্ধারণ হয়।

    ভারতে কোনও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ভাঙতে হলে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করতে  লাগে না; তাকে কেবল এমনভাবে রূপান্তরিত করা হয় যাতে তার চরিত্র বদলে যায়। যেমন পুলিশ প্রশাসন স্থানীয় প্রভাবশালী জাতি গোষ্ঠীর অধীনেই কাজ করে, আদালতগুলিকেও ধীরে ধীরে এমন এক কাঠামোয় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেখানে তারা সংবিধানের নীতির চেয়ে “হিন্দু সমাজের ইচ্ছা” অনুযায়ী রায় দেবে। রাম জন্মভূমি, গিয়ানবাপী বা রোহিঙ্গা শরণার্থীর মতো মামলায় আদালতের অবস্থান এই প্রবণতাকেই প্রতিফলিত করে।

    একই সঙ্গে, বিচারপতিদের মন্তব্য, আদালতের ভেতর-বাইরের বক্তব্য, এমনকি তাঁদের বিদেশ সফরের বক্তৃতাও এখন জনমানসে আদালতের ভাবমূর্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। বিচারপতি গাভাই মরিশাসে তাঁর ‘বুলডোজার রায়’-এর প্রশংসা করে আসলে বোঝাতে চেয়েছিলেন, ভারতের আদালত এখনো আইন ও ন্যায়ের শাসনের পক্ষে দাঁড়াতে পারে।

    জাতি-ভিত্তিক সমাজে ন্যায়ের পথে দাঁড়ানো সবসময় বিপজ্জনক। খৈরলাঙ্গি হত্যাকাণ্ডে যেমন দেখা গিয়েছিল, আইনের শরণ নেওয়া দলিত পরিবারগুলোকে কী ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়। আজ হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র কাঠামো সেই দমননীতিকেই আরও বৈধতা দিচ্ছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ‘গো-রক্ষা বাহিনী’র সহিংসতায় পুলিশের সহযোগিতা বা মুসলিম ও দলিতদের উপর বুলডোজার হামলা—সবই সংবিধানের সমতার ধারণাকে মাটিচাপা দিচ্ছে।

    এই প্রেক্ষাপটে বিচারপতি গাভাইয়ের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের ‘বুলডোজার রায়’ সংবিধানের পক্ষে এক তাত্ত্বিক প্রতিবাদ হিসেবে উঠে এসেছে। তাঁর ভাষণে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে আদালতের ভূমিকা রাষ্ট্রের ইচ্ছা পূরণ নয়, বরং আইন ও ন্যায়ের রক্ষাকবচ হওয়া।

    যদিও বিচারপতি গাভাইয়ের উত্তরাধিকার সময়ই নির্ধারণ করবে, তাঁর রায় ও মন্তব্য ইতিমধ্যেই আদালতের ভাবমূর্তিতে এক ভিন্ন দিক নির্দেশ করেছে। তাঁর উপর নিক্ষিপ্ত জুতো আসলে সেই মতাদর্শিক ভয়ের প্রতীক, যা হিন্দুত্ববাদী সমাজ সংবিধানের ন্যায়বিচারের আদর্শের প্রতি অনুভব করছে—একটি জুতোর আঘাত, যা কেবল একজন বিচারপতির নয়, ভারতের সংবিধানকেই লক্ষ্য করে।
  • Link to this news (আজকাল)