পাহাড়ে উন্নয়ন নয়, ‘রাজনীতি’ই উদ্দেশ্য পদ্ম শিবিরের! বিপর্যয়ের মাঝেই বিমল গুরুংয়ের সঙ্গে বৈঠকে কিরেন রিজিজু...
আজকাল | ১১ অক্টোবর ২০২৫
গোপাল সাহা
এখনও সপ্তাহ ঘোরেনি। গত শনিবার রাতে ভয়াবহ নিম্নচাপ ও ঘূর্ণাবর্তে কারণে দার্জিলিং-সহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় নেমে আসে বিরাট বিপর্যয়। জলের তলায় তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম, দেখা যায় মানুষ ও গবাদি পশুদের মৃত্যু মিছিল। তথ্য অনুযায়ী শিশু ও মহিলা-সহ ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ বহু। একই সঙ্গে মানুষের আর্তনাদ ও হাহাকার যা শ্মশানপুরীর থেকেও ভয়ংকর। জঙ্গল থেকে প্রাণ রক্ষার দায়ে হিংস্র প্রাণীরা ছুটে আসছে গ্রামের মধ্যে লোকালয়ে, ফলে সেখানেও তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক। এরই মাঝেই ২৬’ এর নির্বাচনে আখের গোছাতে রাজনীতি করতে নেমে পড়েছে পদ্ম শিবির। উত্তরবঙ্গে বাংলার শাসকদল আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি তেমন। ভোটের নিরিখে জায়গা করেছিল পদ্ম শিবির। কিন্তু মানুষের ভরসা ও বিশ্বাসের মর্যাদা সত্যি কি রাখতে পারল বঙ্গ বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার? বারবার ঘুরে আসছে সেই প্রশ্ন। দার্জিলিংয়ের সাংসদ বিজেপির রাজু বিস্তা এবং একই সঙ্গে বিধায়ক সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কিন্তু উন্নয়নের কথা আসলেই সেখানে রাজনৈতিক চিত্রটা ঠিক খুড়োর কলের মত। এই পার্বত্য অঞ্চলে কেন্দ্রের উন্নয়ন সাধারণ মানুষ বারবার শুনে আসছে কিন্তু কেউ কোনও দিন চাক্ষুস করতে পারলেন না। উত্তরবঙ্গের উন্নয়নে যাথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শান্তি ফিরে এসেছে। যা সিপিএম আমলে ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু কেন্দ্রের একাধিক জনপ্রতিনিধি থাকতেও উন্নয়নের ভাড়ার একপ্রকার শূন্য।
বিধানসভা ভোটের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। পাহাড়ের হাওয়ায় এখন রাজনীতির গন্ধ তীব্র। শাসক-বিরোধী তরজা নেহাতই কম নয়। আর ঠিক সেই জায়গায় ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে বিজেপির বাজিমাত করার একটা প্রবল চেষ্টার চিত্র প্রকাশ্যে আসছে, বিমল গুরুং-কে দলে টানার প্রবল চেষ্টা। দার্জিলিংয়ের রাজনৈতিক মাটিতে যেন ফের নড়াচড়া শুরু করেছে পুরনো ভূমিকম্প। কারণ, দীর্ঘ নীরবতার পর ফের সক্রিয় হয়েছেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (জিজেএম) নেতা। তাঁর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক তৎপরতা পাহাড়ে নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একই সঙ্গে এই বিপর্যয়ের মাঝে উত্তরবঙ্গ পরিদর্শনের ফাঁকে রিজিজুর সঙ্গে গুরুং বৈঠক অতীব তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল।
গোর্খাল্যান্ড ও পাহাড়ের রাজনীতি
পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ডের নতুন বিষয় নয়। আশির দশকে সুবাস ঘিসিংয়ের জিএনএলএফ এই দাবিকে ঘিরে পাহাড়ের রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য করেছিল। কিন্তু সময় বদলায়, ঘিসিংকেই সরিয়ে পাহাড়ের রাজনীতিতে নতুন ‘সম্রাট’ হয়ে ওঠেন বিমল। ২০০৯ ও ২০১৪ দু’বারই বিজেপির দার্জিলিং জয় নিশ্চিত করতে মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁরই। তবে ২০১৭ সালের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় পুলিশ আধিকারিক অমিতাভ মালিকের মৃত্যুর পর গা ঢাকা দেন গুরুং। সেখান থেকেই তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্ব যেন ঝাপসা হতে শুরু করে।
ফের রাজনীতির ময়দানে গুরুং
২০২১ সালে পাহাড়ে প্রত্যাবর্তন ঘটে বিমলের। প্রথমে তৃণমূলকে সমর্থনের ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে ফের বিজেপিতে যোগ দেন। কিন্তু ততদিনে পাহাড়ের রাজনীতিতে নতুন মুখ অনীত থাপা ও বিনয় তামাং নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন। ২১’এর ভোটে পাহাড়ের তিন আসনের মধ্যে দু’টিতে জয় পায় বিজেপি, একটিতে অনীতের ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা (বিজিপিএম)। জিটিএ নির্বাচনে গুরুং সরাসরি প্রার্থী না হলেও তাঁর দল মোর্চা জিএনএলএফ ও বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে লড়ে। কিন্তু ফল তেমন অনুকূলে আসেনি। পাহাড়ের প্রশাসনিক ক্ষমতা পায় অনীতের দল।
২০২৬-এর আগে পাহাড়ে নতুন সমীকরণ
বর্তমানে মোর্চা কোণঠাসা হলেও বিমল সক্রিয়ভাবে মাঠে নামছেন। কয়েক মাস আগে তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধা রোশন গিরি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে কলকাতায় বৈঠক করেন। সম্প্রতি বিমল কিরেন রিজিজুর সঙ্গে দেখা করেছেন দার্জিলিংয়ে। রিজিজু তখন পাহাড়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন। সূত্রের খবর, গুরুং নাকি রিজিজুর কাছে স্পষ্ট জানিয়েছেন, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তিনি লড়াই করতে চান এবং পাহাড়ের তিনটি আসনের মধ্যে অন্তত একটি আসন বিজেপি যেন মোর্চাকে ছাড়ে। এই বিষয়ে বিমল বলেছেন, “আমি কিরেন রিজিজুর সঙ্গে পাহাড়ের স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান ও ১১ জনজাতির সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে বিষয়টি জানাবেন।”
দলের ১৮তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে দার্জিলিংয়ের চৌরাস্তায় অনুষ্ঠিত সভায় বিমল ফের পাহাড়বাসীর কাছে ‘একটা সুযোগ’ চান। বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, “এবার সরাসরি নির্বাচনে লড়ব। পাহাড়ে দুর্নীতি ও টাকার রাজনীতি চলছে। আমরা পাহাড়বাসীর কাছ থেকে একবার সুযোগ চাই। সুযোগ পেলে দেড় বছরের মধ্যে পাহাড়ের চেহারা বদলে দেব।” এই সভায় বিজেপির একাধিক স্থানীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন, যা পাহাড়ের রাজনৈতিক জোট-সম্ভাবনাকে আরও জোরদার করছে।
দার্জিলিংয়ের সাংসদ রাজু বিস্তা বলেছেন, “বিমল গুরুং আমার রাজনৈতিক গুরু। তিনি প্রথম থেকেই বিজেপির সঙ্গে ছিলেন, আছেন ও থাকবেন। আগামী নির্বাচনে তিনি অংশ নিলে আমরা স্বাগত জানাব। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে দল।”
অন্যদিকে, তৃণমূলের মুখপাত্র তথা রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, “এরা পরিযায়ী পাখির মতো, যখন ভোট আসে তখন উড়ে আসে আর সারা বছর দেখা যায় না। বিজেপি আদতে উদ্দেশ্যহীনভাবে চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়। মানুষ এদের চরিত্র বুঝে গেছে। আসল উন্নয়ন করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর মানুষ এদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে গেছে, এবার আর মানুষ এদের ভোট দেবে না।”
এখন প্রশ্ন, বিমল কি ফের পাহাড়ের ভোটযুদ্ধে নামছেন? গুরুংয়ের মোর্চা কি বিজেপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক জোট করবে না কি তৃণমূলের সঙ্গে? যদি বিজেপির সঙ্গে জোট হয়, তাহলে পাহাড়ের রাজনৈতিক ভারসাম্য কোন খাতে গড়াবে?
ভোটের কাউন্টডাউন যত এগোচ্ছে, দার্জিলিংয়ের বাতাসে ততই জোরালো হচ্ছে রাজনৈতিক গুঞ্জন, পাহাড়ে কি ফের গুরুং যুগ ফিরছে বিজেপির হাত ধরে?