• বিশেষ নিবিড় সংশোধনকে হাতিয়ার করে বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসনের ছক! বিরোধীদের মন্তব্যে বিতর্ক তুঙ্গে, এপ্রিলেই ভোটের ইঙ্গিত...
    আজকাল | ১২ অক্টোবর ২০২৫
  • গোপাল সাহা

    ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোট যত এগিয়ে আসছে, ততই রাজ্যে রাজনৈতিক সমীকরণ নতুন মোড় নিচ্ছে। রাজ্যজুড়ে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের রাজ্যস্তরের আধিকারিকদের চলছে বৈঠক। গত বৃহস্পতিবার কোলাঘাটে তিন জেলার প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকদের বৈঠক হয়। সূত্রের খবর, বৈঠকে জানানো হয়েছে রাজ্যে বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) শেষ হওয়ার তিন মাস পরেই  বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ, এসআইআর যদি অক্টোবরেই শুরু হয়, তাহলে ভোট এপ্রিলে হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও ঝাড়গ্রামের জেলা প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকরা। কমিশনের টিম প্রস্তুতি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

    এই পরিস্থিতিতেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন তুলেছে। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “ছাব্বিশের ভোট যদি করতে হয়, তাহলে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই দিনক্ষণ ঘোষণা করতে হবে। জানুয়ারিতে ফাইনাল ভোটার তালিকা বেরবে। এসআইআর শেষ হতেই যে কোনও দিন ভোটের তারিখ ঘোষণা সম্ভব। ২০২১ সালে ৫ মে সরকার গঠিত হয়েছিল। সুতরাং ২০ থেকে ২৫ এপ্রিলের মধ্যে ভোট প্রক্রিয়া শেষ না হলে রাষ্ট্রপতি শাসন কার্যকর হতে পারে।”

    তাঁর দাবি, এক কোটিরও বেশি নাম বাদ দেওয়া উচিত এসআইআরে। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি এই প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবে বলেও জানান শুভেন্দু। তাঁর স্পষ্ট হুঁশিয়ারি, “এসআইআর শুরু হলে সরকার ও তৃণমূল কতটা সহযোগিতা করবে, তার উপরই সব নির্ভর করছে।”

    এই বিষয়ে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক দুলাল ঘোষ বলেন, “কেন্দ্র সরকার নির্বাচন কমিশনকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছে এবং তারা বুঝতে পেরেছে ভোটে জিততে পারবে না, তাই এসআইআর-এর মাধ্যমে এনআরসি করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তৃণমূল এ ধরনের রাজনীতি কোনও ভাবেই হতে দেবে না। মানুষ তৃণমূলকেই বেছে নেবে। কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিরোধী দল পদ্মশিবির চাইছে এই সুযোগে রাজ্যে একটা অরাজকতা সৃষ্টি করে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা জারি করার। সেই স্বপ্ন কোনও দিনই সফল হবে না শুভেন্দুর।”

    এর আগে তৃণমূলের সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি এসআইআর নিয়ে কেন্দ্রকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাকে এই নিয়ে একাধিকবার কাঠগড়াও তুলেছেন। মমতা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, “এসআইআর-এর নাম করে ভোটার তালিকা থেকে কারও নাম বাদ দেওয়া যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাকে নানাভাবে কলুষিত করার চেষ্টা করছে এবং ঘুরপথে এনআরসি করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা এবং সম্প্রীতি নষ্ট করার একটা প্রবল চেষ্টা চালাচ্ছে, যা আমি কোনও দিন হতে দেব না।”

    কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্রও এনআরসি নিয়ে কেন্দ্রকে একাধিক তোপ দেখেছেন। কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিরোধী দল এসআইআর-এর মাধ্যমে বিভাজনের রাজনীতি করছে, এই রাজ্যে কোনও বিভাজন বা ধর্মবিদ্বেষ সৃষ্টি হতে দেবে না বলেও স্পষ্ট জানিয়েছিলেন মহুয়া। 

    উত্তরবঙ্গে বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু আক্রান্ত হওয়ার পর শুভেন্দু রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের উপর ‘চাপ’ বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, “বেঙ্গল ওয়ান্টস অ্যাকশন”। তবে শুভেন্দু এটাও স্বীকার করেছেন যে আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত, ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু করার নেই। তবুও তিনি রাজ্যপালের সক্রিয় ভূমিকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন,  “রাজ্যপাল শুধু রিপোর্ট দিলে হবে না, অ্যাকশন নিতে হবে।” উল্লেখ্য, রাজ্যপালের সঙ্গে শুভেন্দুর সম্পর্ক আগেও খুব মধুর ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা রাজ্যপালের প্রতি প্রত্যাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।

    নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী, ১১-১৫ অক্টোবরের মধ্যেই এসআইআর সংক্রান্ত যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করতে বলা হয়েছে। কমিশন চাইছে কালীপুজোর পরেই এসআইআরে প্রক্রিয়া শুরু হোক। যাতে জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ সম্ভব হয়। কমিশন এবার বিশেষভাবে সতর্ক। বিহারে যে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল (বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পর ফর্ম ছাপানো), তা এড়াতে আগাম প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছে।

    রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, শুভেন্দুর সাম্প্রতিক মন্তব্যে বিজেপির কৌশলের ইঙ্গিত মিলছে। রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং এসআইআর নিয়ে বিরোধী দলনেতার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসনের জল্পনা। তাদের মতে, শুভেন্দু চাইছেন একদিকে রাজ্যপালের উপর চাপ বাড়াতে, অন্যদিকে রাজ্যে ভোট-পূর্ব রাজনৈতিক আবহ বদলাতে।

    এসআইআর নিয়ে রাজ্যজুড়ে যখন সরকারি কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, তখন শুভেন্দুর মন্তব্যে নতুন করে চাঞ্চল্য। কিন্তু সেই ভোটের আগে কি রাজ্যে বদলাবে রাজনৈতিক সমীকরণ? নাকি শুভেন্দুর ইঙ্গিতই সত্যি হবে, রাষ্ট্রপতি শাসনের ছায়া ঘনাবে বাংলার আকাশে— এখন সেটাই বড় প্রশ্ন।
  • Link to this news (আজকাল)