রাজনগরে ফিরল জওয়ানের দেহ, কালীপুজোয় বাড়ি ফেরার কথা ছিল, কান্নার রোল গ্রামে
বর্তমান | ১২ অক্টোবর ২০২৫
পিনাকী ধোলে, রাজনগর: কালীপুজো উপলক্ষ্যে আগামী ১৪অক্টোবর বাড়ি ফেরার কথা ছিল। তার আগেই ফিরলেন। কিন্তু, কফিনবন্দি হয়ে। কাশ্মীরে নিহত সেনা জওয়ান সুজয় ঘোষের কফিনবন্দি নিথর মৃতদেহ ফিরল গ্রামে। শনিবার বিকেলে জাতীয় পতাকায় মোড়া জওয়ানের কফিনবন্দি দেহ বীরভূমের রাজনগরের কুণ্ডিরা গ্রামে এসে পৌঁছয়। কান্নার রোল ওঠে গ্রামে। গ্রামেরই একটি খেলার মাঠে নিহত জওয়ানকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। ভারত মায়ের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। বীর জওয়ানকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভারতীয় সেনার পদস্থ কর্তারা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বীরভূমের জেলাশাসক বিধান রায়, জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখ, সিউড়ির বিধায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী, দুবরাজাপুরের বিধায়ক অনুপ সাহা, বিজেপির বীরভূম সাংগঠনিক জেলা সভাপতি ধ্রুব সাহা প্রমুখ।
চলতি সপ্তাহেই দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগে জঙ্গিদমন অভিযান চলাকালীন হঠাৎ তুষারঝড় শুরু হওয়ায় নিখোঁজ হয়ে যান দুই বাঙালি প্যারা কমান্ডো পলাশ ঘোষ ও ল্যান্সনায়েক সুজয় ঘোষ। দু’জনেই দক্ষ এলিট শ্রেণির প্যারাট্রুপার। সুজয়ের বাড়ি রাজনগরের কুণ্ডিরা গ্রামে। পলাশ মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার রুকুনপুরের বাসিন্দা। শুক্রবারই দুই জওয়ানের বাড়িতেই তাঁদের মৃত্যুর খবর আসে। শনিবার বিকেলে শববাহী গাড়িতে গ্রামে সুজয়ের দেহ এসে পৌঁছয়।
শুক্রবার সুজয়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই কেঁদে কেঁদে চোখের জল কার্যত শুকিয়ে গিয়েছে তাঁর দাদা মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের। তিনি বলেন, এবারের দুর্গাপুজোর সময়েই বাড়িতে আসার কথা ছিল ভাইয়ের। কিন্তু পুজোয় ছুটি পায়নি। তাই আগামী কালীপুজো উপলক্ষ্যে ১৪অক্টোবর বাড়ি আসার কথা ছিল। গ্রামের বাসিন্দা বন্দনা মণ্ডল, আল্পনা মণ্ডল বলেন, গ্রামে খুব ধুমধাম করে কালীপুজো হয়। সুজয় যেখানেই থাকুক, কালীপুজোয় গ্রামে আসত। ও আর ওর বন্ধুরা মিলেই পুজোর কয়েকটা দিন গোটা গ্রামে মাতিয়ে রাখত। কিন্তু, তার আগেই সব শেষ! সুজয়ের মৃত্যুর পর থেকেই প্রলাপ বকছেন তাঁর অশীতিপর বৃদ্ধ দাদু শরৎ ঘোষ, ‘আমার নাতি মরতেই পারে না। গুলি হজম করেও ও ফিরে আসবে...’।
দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান সুজয় মাত্র দু’বছর বয়সেই মাকে হারান। দ্বিতীয় বিয়ে করেন বাবা রাধেশ্যাম ঘোষ। তবে, মায়ের অভাব কখনই বুঝতে দেননি সৎ মা। তিনিই কোলেপিঠে মানুষ করেন সুজয়কে। সুজয় সেনায় যোগ দেওয়ার পর থেকেই সংসারের হাল ফেরে। মাটির বাড়ির জায়গায় পাকা বাড়ি হয়েছে, গাড়ি কিনেছেন। প্রতিবেশীরা বলছিলেন, চাকরি পাওয়ার জন্য খুবই কসরত করত। ভোরে ঘুম থেকে উঠত। দৌড়ত, বালির বস্তায় ঘুসি মারত। সুজয়ের পিসি মানু সোনার বলেন, ওকে বলতাম এত কষ্ট করিস না। কিন্তু ও বলত একদিন তো কষ্টের ফল পাব। ফল পেয়েওছিল। কিন্তু, তা যে এত ক্ষণস্থায়ী হবে, তা কেউ ভাবতে পারিনি। ভবানীপুর শম্ভুনাথ হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়ার পর বিদ্যাসাগর কলেজ ভর্তি হন সুজয়। সেখানেই দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় চাকরি পান সুজয়। সুজয়ের বন্ধু দীনবন্ধু ঘোষ বলেন, স্কুলে পড়াকালীন ও সেনায় যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখত। তৃতীয়বার পরীক্ষার পর ও চাকরি পেয়েছিল। প্রায় প্রতিদিনই ফোনে কথা হতো। গত সপ্তাহের শনিবার শেষবার কথা হয়। ও জানিয়েছিল এখন বেশিরভাগ সময়ই ওকে বিশেষ জঙ্গিদমন অভিযানে যেতে হচ্ছে। তাই বেশি কথা বলতে পারবে না। কালীপুজোয় এসে দেখা করবে বলেছিল। কিন্তু, তার আগেই সব শেষ। ওকে ছাড়া কালীপুজোর আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল!• শোকার্ত পরিজনরা। (ইনসেটে) শহিদ জওয়ান সুজয় ঘোষ।