• বাংলার দুই কোণের দুই বীর সন্তান, তিরঙ্গার তলে চিরনিদ্রায়, ফিরলেন তাঁদের গ্রামে ...
    আজকাল | ১২ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: কাশ্মীরের অনন্তনাগের ভয়াবহ তুষারঝড়ে প্রাণ হারালেন বাংলার দুই সাহসী সন্তান—বীরভূমের প্যারা কমান্ডো সুজয় ঘোষ এবং মুর্শিদাবাদের প্যারা এসএফ কমান্ডো পলাশ ঘোষ। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা এই দুই শহিদের আত্মত্যাগে শোক আর গর্বে ভরে উঠেছে দুই জেলা। 

    একদিকে বীরভূমের রাজনগরের কুন্ডিরা গ্রাম, অন্যদিকে মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার রুকুনপুর—দু’জায়গাতেই আজ হাজার হাজার মানুষের ঢল, জাতীয় পতাকায় মোড়া দুই বীরের মরদেহ দেখে চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি কেউ। 

    এদিন সকাল থেকেই বীরভূমের রাজনগর ব্লকের কুন্ডিরা গ্রাম যেন স্তব্ধ। সেনাবাহিনীর কনভয়ে কফিনবন্দি অবস্থায় ফিরে আসে দেশের শহিদ সন্তান—প্যারা কমান্ডো সুজয় ঘোষ। তাঁর দেহ আসতেই ভেঙে পড়ে গোটা গ্রাম। শোক আর কান্নায় ভরে ওঠে চারদিক। প্রিয়জন, প্রতিবেশী, সহপাঠী—সবাই ছুটে আসেন শেষবারের মতো তাঁকে দেখতে। শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হন বীরভূমের জেলাশাসক বিধান রায়, জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখ, সিউড়ির বিধায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী বিজেপির বীরভূম সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ধ্রুব সাহা-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব। সেনাবাহিনীর মর্যাদাপূর্ণ প্রহরায় শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় এই বীরযোদ্ধাকে। বক্রেশ্বর শ্মশানে সম্পন্ন হয় তাঁর শেষকৃত্য, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। 

    প্রিয় ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর বাবা রাধেশ্যাম ঘোষ, মা নমিতা ঘোষ। দাদা মৃত্যঞ্জয় ঘোষ বলেন, ভাই দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে—এটাই একমাত্র সান্ত্বনা। এলাকায় শোকের ছায়া ঘনিয়ে এসেছে, তবে গর্বও কম নয়, কারণ দেশের জন্য আত্মবলিদান দিয়েছেন বীরভূমের সন্তান সুজয়। সেনা সূত্রে জানা গিয়েছে, অনন্তনাগের তুষারঢাকা পাহাড়ি অভিযানে আকস্মিক ঝড় ও তুষারপাতের মধ্যে চাপা পড়েন সুজয়। বরফ সরিয়ে তাঁর দেহ উদ্ধার করা হয় সহযোদ্ধাদের দ্বারা। 

    অন্যদিকে, মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া থানার রুকুনপুর-বলরামপুরের বাসিন্দা পলাশ ঘোষও ফিরলেন জাতীয় পতাকায় মোড়া অবস্থায়। নিজের ছোট্ট দুই মেয়েকে কথা দিয়ে গিয়েছিলেন—পরেরবার বাড়ি ফিরবেন সেনার ইউনিফর্ম পরে, বুকের উপর থাকবে তিরঙ্গা। সেই কথা রেখেছেন তিনি। তবে তিনি ফিরলেন কফিনে। শেষবারের মতো। 

    ভারতীয় সেনাবাহিনীর এলিট ফোর্স প্যারা এসএফ-এর সদস্য পলাশ গত সপ্তাহে অনন্তনাগে জঙ্গি দমনে ওই একই অভিযানে গিয়ে ভয়ঙ্কর তুষারঝড়ে বরফের নিচে চাপা পড়েন। পরে সহযোদ্ধারা তাঁর দেহ উদ্ধার করেন। ২০০৯ সালে সেনায় যোগ দিয়ে বাড়ির আর্থিক হাল ফেরান পলাশ। হরিহরপাড়া রুকুনপুর হাই স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষে বহরমপুর কলেজে দর্শন নিয়ে ভর্তি হলেও সেনার চাকরিতে যোগ দিতে পড়াশোনা মাঝপথে ছাড়েন। 

    শনিবার সন্ধ্যায় সেনা কনভয়ে করে গ্রামের বাড়িতে আনা হয় পলাশের নিথর দেহ। জাতীয় পতাকা হাতে হাজারো মানুষ তখন ছুটে আসে শেষবারের মতো এক নজর দেখতে। 

    পলাশের বাবা প্রশান্ত ঘোষ বলেন, 'আমার ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে, আমি গর্বিত।' মা আদুরী ঘোষ ও স্ত্রীর কান্নায় ভেসে যায় চারদিক। এখনও বুঝে উঠতে পারেনি তাঁর দুই কন্যা সন্তান—বাবা ফিরেছেন, অথচ সবাই কাঁদছে কেন! 

    দুই জেলার দুই প্রান্তের দুই বীর—সুজয় ঘোষ ও পলাশ ঘোষ—একই অভিযানে প্রাণ দিয়েছেন মাতৃভূমির জন্য। তাঁদের আত্মত্যাগে নত হয়েছে বাংলা-সহ গোটা দেশ। জাতীয় পতাকায় মোড়া তাঁদের দেহ কাঁদিয়েছে সমগ্র দেশকে। শহীদদের নাম চিরকাল উচ্চারিত হবে শ্রদ্ধায়, গর্বে ও অশ্রুজলে।
  • Link to this news (আজকাল)