দল খেলা-মেলায় চলে গেলে রাজনৈতিক বোধ থাকে না! সৌগতের চ্যালেঞ্জ কি নেত্রী মমতাকেই? তৃণমূলেও জল্পনা
আনন্দবাজার | ১২ অক্টোবর ২০২৫
ফের বিতর্ক তৃণমূলের অন্দরে। সৌজন্যে আবার সৌগত রায়। ‘খেলা-মেলা’ নিয়ে দমদমের প্রবীণ তৃণমূল সাংসদের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়তেই শাসকদলের অন্দরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, সৌগত কি দলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দর্শনকেই চ্যালেঞ্জ করছেন?
পুজোর পরে তৃণমূল আপাতত বিজয়া সম্মিলনীতে মনোনিবেশ করেছে। ব্লকে ব্লকে সেই কর্মসূচি শুরু হয়েছে গত ৫ অক্টোবর থেকে। শুক্রবার বরাহনগর শহর তৃণমূলের উদ্যোগে আয়োজিত বিজয়া সম্মিলনীর মঞ্চ থেকে সৌগত বলেছেন, ‘‘যদি কোনও একটা পার্টি খেলা-মেলার মধ্যে চলে যায়, তবে তার পলিটিক্যাল সেন্স (রাজনৈতিক বোধ) চলে যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, ছ’মাস পরে নির্বাচন। জেতাটাই আমাদের কাছে একমাত্র লক্ষ্য। অন্য কিছু এখন করবেন না।’’
সেখানেই থামেননি সৌগত। বরাহনগর পুরসভার পুরপ্রধান অপর্ণা মৌলিককে তিনি ‘ধন্যবাদ’ জানান এই কারণে যে, অপর্ণা উদ্যোগ নিয়ে ‘বরাহনগর উৎসব’ বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, বরাহনগর সৌগতের লোকসভা কেন্দ্র দমদমের অন্তর্গত।
‘খেলা-মেলা’ নিয়ে একটা সময়ে সিপিএম, কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলগুলি মমতার সমালোচনা করত। বেশ কয়েক বছর আগে সেই সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘‘আমরা মানুষকে নিয়ে উৎসব করলেও কারও কারও গায়ে ফোস্কা পড়ে! উৎসব করব না তো কি শ্রাদ্ধ করব?’’ ঘটনাচক্রে, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতা উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন উৎসবকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব, আদিবাসী দিবসের উৎসব তো বটেই, দুর্গাপুজোর বিসর্জনকেও ‘কার্নিভালের’ রূপ দেওয়া মমতারই মস্তিষ্কপ্রসূত। আবার খেলার প্রশ্নে মফস্সল শহরগুলিতে ‘এমএলএ কাপ’ ফুটবল মহলে জনপ্রিয় হয়েছে। দলের অন্যতম নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে বেশ জাঁকজমক করে এমপি কাপের আয়োজন করেন। তিনি যে খেলার উপর জোর দিতে চান, তা অভিষেকের ডায়মন্ড হারবার ফুটবল ক্লাব নিয়ে আগ্রহই প্রমাণ করে। তাঁর দল এ বছর প্রথম বার ডুরান্ড কাপ খেলেই রানার্স হয়েছে।
সৌগত মাঝে কয়েক মাস গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। প্রথমে তাঁর পেসমেকার বসে। তার পরে স্নায়ুর জটিল রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। মাস খানেক হল তিনি সুস্থ হয়েছেন। গত মাসে দিল্লিতে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটও দিতে গিয়েছিলেন। দলীয় কর্মসূচিতেও যোগ দিচ্ছেন। তা করতে গিয়েই ফের বিতর্ক তৈরি করল দমদমের চার বারের সাংসদের মন্তব্য। সৌগতের ওই বক্তব্য ছড়িয়ে পড়তেই ‘অস্বস্তি’তে পড়েছে তৃণমূল। দলের প্রথম সারির একাধিক নেতা একান্ত আলোচনায় স্বীকার করে নিচ্ছেন, সৌগত যা বলেছেন, তাতে মমতার রাজনৈতিক দর্শনকেই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এক প্রবীণ সাংসদের বক্তব্য, ‘‘মমতাদি বিশ্বাস করেন, সারাবছর সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি থেকে দলীয় কর্মীদের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হবে। তাতে মেলা, খেলা, সাংস্কৃতিক উৎসব গুরুত্বপূর্ণ। সৌগতদা তো পুরো উল্টো কথা বলেছেন!’’ তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘সৌগতদা কী বলেছেন পুরোটা শুনিনি। তবে সারা বছর সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে থাকব না আর ভোটের সময়ে ভোট চাইতে যাব, এটা তো হতে পারে না! সামাজিক কর্মসূচি অনেক বেশি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার পরিসর তৈরি করে দেয়।’’
অর্থাৎ, তৃণমূলের অন্দরে সৌগতের বক্তব্যের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছেন না। সৌগতের বিতর্কে জড়িয়ে পড়া অবশ্য নতুন নয়। গত তিন বছরে তাঁর একাধিক মন্তব্য ঘিরে ডামাডোল হয়েছে। ২০২২ সালে হঠাৎ করেই সৌগত বলেছিলেন, পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাকের সঙ্গে তৃণমূলের চুক্তিভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। যা নিয়ে দলের এক প্রথম সারির নেতা মমতার নির্দেশেই সৌগতকে ফোন করে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি যেন মুখে কুলুপ আঁটেন। গত মার্চে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি চলাকালীন সৌগত হঠাৎ বলে বসেন, রোহিত শর্মাকে দল থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া উচিত। ঘটনাচক্রে, রোহিতের নেতৃত্বেই ভারত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তার পরে ট্রফি হাতে রোহিতের ছবি পোস্ট করে কুণালই সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘রোহিতের এই সাফল্যের পিছনে অধ্যাপক রায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য!’
সম্প্রতি ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা (এসআইআর) নিয়েও মমতার উল্টো মন্তব্য করেছেন সৌগত। তৃণমূল নেত্রী যখন এসআইআর নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ‘রণং দেহি’ মেজাজ নিয়েছেন, তখন সৌগত বলেছেন, ‘‘এসআইআর হলে ভোটার তালিকার সংশোধন হবে। এতে আপত্তির কিছু দেখছি না!’’
শনিবার সৌগত এসআইআর সম্পর্কে কার্যত একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘যে ভাবে এসআইআর করতে চাইছে কমিশন, সেটা ঠিক নয়।’’ তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, কালীঘাটের বার্তা পেয়েই সৌগত এসআইআর নিয়ে ডিগবাজি দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যেই ‘খেলা-মেলা’ নিয়ে মন্তব্য করে বসলেন প্রবীণ সাংসদ। এখন দেখার, তাঁর এই মন্তব্যের ‘চাপ’ কী করে সামলায় তৃণমূল। বিশেষত, বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে।