মন্ত্রী হয়ে আশানুরূপ আয় নেই! তাই পদ ছাড়তে চান! বিজেপির অভিনেতা-সাংসদ সুরেশ গোপীর স্বীকারোক্তি ঘিরে তুঙ্গে বিতর্ক...
আজকাল | ১৩ অক্টোবর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: রাজনীতি যে ফিল্মি চিত্রনাট্যের থেকে অনেকটাই আলাদা, লাভ ক্ষতির অঙ্ক মেলাতে না পেরে কি তবে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি কেরলের বিজেপি সাংসদ সুরেশ গোপী? কেরলে বিজেপির প্রথম লোকসভা সাংসদ হিসেবে ইতিহাস তৈরি করার কয়েকমাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়ার তাঁর আকস্মিক ইচ্ছাপ্রকাশে জাতীয় রাজনীতিতে তীব্র জল্পনা শুরু হয়েছে। রবিবার দলীয় এক অনুষ্ঠানে তিনি কেবল পদত্যাগের ইচ্ছাই প্রকাশ করেননি, নিজের জায়গায় বর্ষীয়ান নেতা সি সদানন্দন মাস্টারকে মন্ত্রী করার সুপারিশ করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে এই পদক্ষেপকে দলের প্রতি আনুগত্য এবং এক প্রবীণ নেতাকে সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টা বলে মনে হলেও, এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা বার্তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক মহল। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সুরেশ গোপীর এই মন্তব্য তাঁর রাজনৈতিক অপরিপক্বতা এবং মোহভঙ্গেরই ইঙ্গিত।
সুরেশ বলেন, "আমি অভিনয় জীবন ছেড়ে মন্ত্রী হতে চাইনি।" কিন্তু এখানেই শেষ নয় এর পর সুরেশ যে মন্তব্য করেন তাই নিয়েই বিতর্ক। সাংসদের দাবি মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর আয় কমে গিয়েছে। এসবকেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মুখ থেকে এমন মন্তব্য অপ্রত্যাশিত শুনে বিপাকে পদ্ম শিবিরও।
সাধারণত, রাজনীতিকরা ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির কথা প্রকাশ্যে আনা থেকে বিরত থাকেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গোপীর এই স্বীকারোক্তি বুঝিয়ে দেয়, অভিনয়ের গ্ল্যামারাস জগৎ এবং ক্ষমতার অলিন্দে বিচরণের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, তা হয়তো তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। মন্ত্রিত্বের গুরুদায়িত্ব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ব্যক্তিগত জীবনে তার প্রভাব- এই সবকিছু মিলিয়েই কি তাঁর এই 'সন্ন্যাস' নেওয়ার ইচ্ছা? এই নিয়েই সরগরম কেন্দ্র থেকে কেরল।
অবশ্য অন্য একটি ব্যাখ্যাও উঠে আসছে। বিরোধীদের একাংশের ব্যাখ্যা - এটি নিছকই এক সুচতুর রাজনৈতিক চাল। সদানন্দন মাস্টারকে মন্ত্রী করার সুপারিশ করে এক তীরে একাধিক পাখি মারার চেষ্টা করেছেন গোপী। প্রথমত, কেরলের বিজেপির অন্দরে থাকা পুরনো এবং বর্ষীয়ান নেতাদের কাছে তিনি বার্তা দিলেন যে, নবাগত হয়েও তিনি তাঁদের সম্মান করেন। কন্নুর-এর মতো রাজনৈতিক ভাবে সংবেদনশীল এলাকা থেকে উঠে আসা সদানন্দনকে এগিয়ে দিয়ে তিনি দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয়ত, এই 'ত্যাগের' ঘোষণার মাধ্যমে তিনি নিজের ভাবমূর্তিকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাইছেন। বার্তাটি স্পষ্ট- তিনি পদের জন্য লালায়িত নন, দলের স্বার্থই তাঁর কাছে বড়। যদি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁর এই 'আর্জি' খারিজ করে দেয়, তবে তিনি দলের প্রতি দায়বদ্ধ এক 'অনিচ্ছুক নায়ক' হিসেবেই থেকে যাবেন।
তবে প্রশ্ন উঠছে তাঁর এই ঘোষণার সময় নিয়ে। কেন তিনি দলের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে এই প্রস্তাব না দিয়ে প্রকাশ্যে দলীয় কর্মীদের সামনে এমন মন্তব্য করলেন? এটি কি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টির কৌশল? তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন যে, তাঁকে মন্ত্রী করার সিদ্ধান্ত যতটা না তাঁর ইচ্ছায়, তার চেয়ে বেশি জনতার রায়ের এবং দলের নির্দেশে।
সব মিলিয়ে, সুরেশ গোপীর এই মন্তব্য এক দিকে যেমন তাঁর ব্যক্তিগত অস্বস্তির প্রতিফলন, তেমনই অন্য দিকে এক গভীর রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হতে পারে। তাঁর এই 'নাটকীয়' পদত্যাগের ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা সময়ই বলবে। তবে এই ঘটনা যে কেরলের রাজনীতিতে বিজেপির অভ্যন্তরীণ রসায়ন এবং তারকা প্রার্থীদের রাজনীতির দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে এক বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিল, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অভিনয়ের মঞ্চে প্রবেশ এবং প্রস্থান দুটোই নায়কের হাতে থাকে, কিন্তু রাজনীতির মঞ্চে একবার প্রবেশ করলে বেরিয়ে যাওয়ার পথটা অতটা সহজ নয়। সুরেশ গোপী কি সেই কঠিন সত্যেরই সম্মুখীন হয়েছেন?
ছেড়ে কথা বলছে না কেরলের বাম শিবির। তাদের স্পষ্ট কথা, ব্যক্তিগত লাভের জন্যই রাজনীতিতে এসেছিলেন অভিনেতা। সেই লাভ ক্ষতির অঙ্ক মেলাতে না পেরেই এই ধরনের মন্তব্য করেছেন তিনি। এমনিতেই কন্নুর বামেদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বাম কংগ্রেস ভোট কাটাকাটির সুযোগে বিজেপির ঝুলিতে যায় আসনটি। গোপী সাংসদ পদ থেকে পদত্যাগ করলে যখন উপনির্বাচন হবে তখন যাতে আর আগের ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়, তাও নিশ্চিত করতে চায় বামেরা। তাই এই জল কদ্দুর গড়ায় সেটাই এখন দেখার।