• হরিয়ানায় উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারের আত্মহত্যা ঘিরে দেশজুড়ে তোলপাড়...
    আজকাল | ১৩ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: হরিয়ানায় সিনিয়র আইপিএস অফিসার ওয়াই. পুরণ কুমারের আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখন দেশজুড়ে রাজনৈতিক ঝড় উঠেছে। গত ৭ অক্টোবর ওই কর্মকর্তা আত্মহত্যা করেন, তবে মৃত্যুর আগে তিনি নিজের উর্দ্ধতন কর্তাদের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈষম্য ও অপমানের অভিযোগ আনেন। এই অভিযোগই ঘটনার গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

    এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুধু হরিয়ানাই নয়, প্রতিবেশী রাজ্য বিহারেও প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, যেখানে আগামী মাসে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকের আত্মহত্যা প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভেতরে জাতিভিত্তিক বৈষম্যের স্থায়িত্ব নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।

    সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, হরিয়ানার বিজেপি সরকার এখনো পর্যন্ত এই ঘটনায় কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়নি। সরকারের সতর্ক ও নীরব অবস্থান বিরোধী দলগুলিকে সুযোগ করে দিয়েছে বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করার এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য।

    মৃত কর্মকর্তার পরিবার দুটি প্রধান দাবি জানিয়েছে। প্রথমত, রাজ্যের ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (ডিজিপি) শত্রুজিৎ সিং কাপুর এবং রোহতক এসপি নরেন্দ্র বিজর্ণিয়ার অবিলম্বে স্থগিতাদেশ ও গ্রেপ্তার। পরিবারের দাবি, এই দুই কর্মকর্তার ষড়যন্ত্রেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। দ্বিতীয়ত, পরিবার চায় এফআইআরে নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হোক এবং তাতে এসসি/এসটি (অত্যাচার প্রতিরোধ) আইনের কঠোর ধারাগুলি যুক্ত করা হোক।

    ১১ অক্টোবর মৃত কর্মকর্তার দুলাভাই এবং পাঞ্জাবের বিধায়ক অমিত রতন সাংবাদিকদের বলেন, “একজন এডিজিপি স্তরের অফিসার মারা গেছেন, পাঁচ দিন কেটে গেছে, তবুও আমরা ন্যায় পাচ্ছি না।”

    পরিবারকে শান্ত করতে হরিয়ানা সরকার ১১ অক্টোবর রোহতক এসপিকে বদলি করে। কিন্তু পরিবার এই পদক্ষেপকে নিছক প্রতীকী বলেই উড়িয়ে দিয়েছে এবং একে “চোখে ধুলো দেওয়া”র প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করেছে।

    এদিকে, মৃতদেহের দাহকার্য এখনো সম্পন্ন হয়নি, কারণ পরিবার এখনো পোস্টমর্টেমের অনুমতি দেয়নি। তাদের দাবি, আগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। চণ্ডীগড় পুলিশ পোস্টমর্টেমের প্রস্তুতি নিলেও পরিবার তাতে রাজি হয়নি, ফলে প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়েছে।

    মৃত কর্মকর্তার স্ত্রী ও আইএএস অফিসার অমনীৎ পি. কুমার দ্য ট্রিবিউন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “সরকার কেন এত তাড়াহুড়ো করছে পোস্টমর্টেমে? আমরা শুধু ন্যায় চাই।”

    এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেশের বহু শীর্ষ নেতা প্রকাশ্যে এসেছেন — সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়গে, মায়াবতী, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, ভগবন্ত মান, চন্দ্রশেখর আজাদ এবং এমনকি বিজেপি-সহযোগী চিরাগ পাসওয়ানও পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

    চণ্ডীগড়ে রবিবার সেক্টর ২০-এ বিভিন্ন দলিত সংগঠন একত্র হয়ে বড় মহাপঞ্চায়েত আয়োজন করে। সেখানে মৃত কর্মকর্তার পরিবারও উপস্থিত ছিলেন। মহাপঞ্চায়েতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয় —১. অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার,২. একটি স্বাধীন বিচারবিভাগীয় তদন্ত,৩. ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত দাহকার্য না করার সিদ্ধান্ত।

    মহাপঞ্চায়েত সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে — যদি এই সময়ের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে গণআন্দোলন শুরু করা হবে।

    এদিকে, কংগ্রেস দলও হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে সরকার ন্যায়বিচার না দিলে রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হবে। কংগ্রেস নেতা রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা বলেন, “যদি একজন এডিজিপি স্তরের অফিসারের পরিবারই ন্যায় না পায়, তবে সাধারণ মানুষ কেমন করে আশা করবে যে এই সরকারের অধীনে বিচার মিলবে?”

    পাঞ্জাব কংগ্রেস সভাপতি রাজা ওয়ারিং চণ্ডীগড়ে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সম্পূর্ণ সংহতি জানান। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চরণজিৎ সিং চন্নি আরও কঠোর মন্তব্য করে বলেন, “এই মৃত্যু আত্মহত্যা নয়, এটি ন্যায়বিচারের হত্যা। তিনি শহীদ হয়েছেন দলিত ও গরিবের অধিকারের জন্য।”

    খাপ পঞ্চায়েতগুলিও পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। চরখি দাদরির খাপ সভাপতি সুরেশ ফোগাট বলেন, “নিচুস্তরের নয়, উচ্চপদস্থ অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো অপরাধী যেন রেহাই না পায়।” সরকারি প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী নয়াব সাইনি শনিবার নির্ধারিত মন্ত্রিসভার বৈঠক বাতিল করে একদল মন্ত্রী ও আমলাকে মৃত কর্মকর্তার স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে পাঠান। পরে তিনি নিজেও বিবৃতি দিয়ে বলেন, “অপরাধী যত প্রভাবশালীই হোক, কেউ রেহাই পাবে না।”

    তবে পরিবারের দাবি অনুযায়ী মূল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো উপযুক্ত  ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, ফলে সরকার ও পরিবারের মধ্যে অচলাবস্থা অব্যাহত রয়েছে। শহীদ ওয়াই. পুরণ কুমার ন্যায় সংগ্রাম মঞ্চ-এর সাধারণ সম্পাদক মুখেশ কুমার বলেন, “এই লড়াই শুধু এক পরিবারের নয়, এটি সম্মান, ন্যায় ও সমতার লড়াই।”

    রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা হরিয়ানার বিজেপি সরকারের সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিষয়টি ইতিমধ্যেই জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে এবং আসন্ন নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এই ঘটনায় স্পষ্ট যে, এক সিনিয়র অফিসারের মৃত্যু এখন প্রশাসনিক জবাবদিহিতা, জাতিভিত্তিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার পরীক্ষাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এখন গোটা দেশ তাকিয়ে আছে — সরকার সত্যিই ন্যায় দেবে, নাকি এই মৃত্যু আরেকটি পরিসংখ্যান হয়ে হারিয়ে যাবে।
  • Link to this news (আজকাল)